শুভাশীষ শর্মা:
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষের জীবনযাত্রায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক নিয়মকানুন থেকে শুরু করে দেশের প্রচলিত আইনের প্রয়োগেও এর প্রভাব উল্লেখযোগ্য। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব থেকে বাঁচার জন্য অত্যাবশ্যকীয় নীতির বিষয়ে আপোষ এবং শিথিলতাও সবাই অকপটে স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু তথাপি এরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও অপরাধীদের দৌরাত্ম্য ও বিবেকবোধহীন মানুষের অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তে যেন এক নতুন রূপ লাভ করেছে। নিয়মিত আদালতব্যবস্থা চালু না থাকার সুযোগে অপরাধীরা তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে যেন আদা জল খেয়ে মাঠে নেমেছে। আমাদের চারপাশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলো থেকে বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয়।
এরূপ পরিস্থিতিতে করোনা ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকানোর উদ্দেশ্যে আদালতের নিয়মিত বিচার ব্যবস্থা বন্ধ রেখে সরকার সীমিত পরিসরে বিচারিক কার্যক্রম চালু রাখার উদ্দেশ্যে আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ জারি করেছেন এবং উক্ত অধ্যাদেশের আলোকে মহামান্য সুপ্রীম কোর্ট নিজস্ব এবং অধস্তন আদালত সমূহের জন্য প্র্যাকটিস নির্দেশনা প্রনয়ণ করেছেন এবং সে অনুযায়ী ভার্চ্যুয়াল আদালতে বর্তমানে বিচারিক কার্যক্রম চলমান আছে।
এ পর্যায়ে সংবিধান স্বীকৃত আইনের আশ্রয় লাভের নাগরিক অধিকার আদৌ কতোটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা বর্তমানে প্রচলিত ভার্চ্যুয়াল আদালতের কার্যক্রমের কতিপয় সীমাবদ্ধতা আলোচনায় প্রতীয়মান হবে।
১. বাংলাদেশের প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার বিবাদমান দুটি পক্ষেরই আইনের আশ্রয় লাভের নাগরিক অধিকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানে স্বীকৃত এবং তা নিশ্চিত করা হয়েছে। আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশে বিচারিক কার্যক্রমের বিভিন্ন পর্যায়ের শুনানি ভার্চ্যুয়ালি করার জন্য সুস্পষ্ট বিধান থাকলেও মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট প্রচারিত প্র্যাকটিস নির্দেশনার আলোকে আদালতসমূহের বাস্তব প্র্যাকটিস পর্যালোচনায় দেখা যায় অদ্যাবধি শুধুমাত্র হাজতী আসামীগণের জামিন আর কতিপয় রিমান্ড শুনানি ব্যতিত উল্লেখযোগ্য অন্য কোন বিচারিক কার্যক্রম করা আদৌ সম্ভব হয়নি। অপরদিকে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের প্রচারিত প্র্যাকটিস নির্দেশনায় ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালতে “প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অতীব জরুরী বিষয়সমূহ শুনানীর” উল্লেখ থাকলেও কোন কোন বিষয়গুলো অতীব জরুরী বিষয় হিসাবে গণ্য হবে তার কোন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় এবিষয়ে সংশয়ের কারনে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।
২. তাহলে আপাতপক্ষে বিচারব্যবস্থায় দুটি পক্ষের মধ্যে কেবলমাত্র একটি পক্ষের আইনী অধিকার কিছুটা বাস্তবায়নে আমরা সমর্থ হয়েছি কিন্তু অপরাধের শিকার বিচারপ্রার্থীর বিষয়টা এখনো বিবেচনা বহির্ভূত। অপরদিকে আইনী বিশ্লেষকরা বলতে পারেন অপরাধের শিকার ব্যক্তির জন্য সংশ্লিষ্ট থানার মাধ্যমে আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করতে হয়, যদিও আইনে বলা আছে যে, আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ এজাহার গ্রহণ ও তা তদন্তের ব্যবস্থা করতে পারেন। এক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তাকে আসামী গ্রেফতার থেকে শুরু করে আমলযোগ্য অপরাধ দমনের জন্য প্রাথমিকভাবে পর্যাপ্ত ক্ষমতা আইনে নিশ্চিত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে অধর্তব্য বা আমল অযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অভিযোগ গ্রহন করলেও সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতি ও পরোয়ানা ব্যতীত যথাক্রমে তদন্ত ও গ্রেফতার করতে পারবেন না। যার ফলে বিরাজমান পরিস্থিতিতে তদন্তের অনুমতি প্রাপ্তি প্রক্রিয়া কষ্টসাধ্য বিধায় সংশ্লিষ্ট থানা অধর্তব্য অপরাধের কোন অভিযোগ গ্রহণ করছে না বললেই চলে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমলযোগ্য অপারাধ কি?ফৌজদারি বিধান কোষের ২য় তপশীলে বর্নিত যে সকল অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় আসামী গ্রেফতারের ক্ষমতা রাখে সেগুলোই হচ্ছে আমলযোগ্য অপরাধ, এ বিষয়ে আইনে কোন অসঙ্গতি বা অস্পষ্টতা নেই, কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে কোন অপরাধ আদৌ আমলযোগ্য কিনা তা কেবলমাত্র সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ এর ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির উপর নির্ভর করে। যতক্ষণ পর্যন্ত অফিসার ইনচার্জ মহোদয় কোন অপরাধের আমলযোগ্যতার বিষয়ে আইনী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যক্তিগতভাবে সন্তুষ্ট না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কোন অপরাধ ধর্তব্য কি অধর্তব্য কিংবা এজাহার গ্রহণ করা বা না করা সম্পূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ এর স্বেচ্ছাধীন বিবেচনা প্রসূত ক্ষমতা না হলেও বাস্তবে তা সেই হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। পক্ষান্তরে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ এর অপরাধের আমলযোগ্যতার বিষয়ে সন্তুষ্ট হয়ে এজাহার গ্রহণের ক্ষেত্রে কথিত স্বেচ্ছাধীন বিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতার চর্চা বা অনুশীলন যে সবক্ষেত্রে ন্যায় সম্মত হয় না তা আমরা কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করলেই এর প্রমাণ পাবো। যেমন আইনের বিধান মোতাবেক সংশ্লিষ্ট থানা কোন এজাহার গ্রহণে অসম্মতি জ্ঞাপন করলে ফরিয়াদী বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নালিশ দায়ের করতে পারেন। আমি আমার ব্যক্তিগত আইন অনুশীলনে এমন অনেক নালিশ মামলা দায়ের হতে দেখেছি, যেখানে ফরিয়াদী সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা দায়েরে ব্যর্থ হয়ে এখতিয়ারসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নালিশ দায়ের করেন, যা বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় উক্ত নালিশ আমলযোগ্য অপরাধ বিবেচনায় সংশ্লিষ্ট থানাকে এফ.আই.আর হিসাবে গণ্য করার আদেশ প্রদান করেছেন অথবা সংশ্লিষ্ট ধারার অপরাধ সরাসরি আমলে নিয়ে পরোয়ানা বা প্রসেস ইস্যু করেছেন। তাহলে এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অফিসার ইনচার্জ তার আইনে প্রদত্ত ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগে ব্যর্থ হয়েছেন যাহা বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয়ের আদেশে প্রতীয়মান হয়। শুধু তাই নয় এমনও নজির আছে যেখানে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে suo-moto বা স্বতঃপ্রণোদিত রুল ইস্যু করে সংশ্লিষ্ট থানাকে এফ.আই.আর গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। পক্ষান্তরে কতিপয় নীতি ও আর্দশচ্যুত, দুর্নীতি পরায়ন অফিসার ইনচার্জ বর্তমান বিরাজমান পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বেআইনী ভাবে লাভবান হয়ে কতিপয় নির্দোষ ও অপরাধের শিকার ব্যক্তির বিরুদ্ধে এজাহার গ্রহণ করে তাদেরকে গ্রেফতার পূর্বক হয়রানি করার জন্য সচেষ্ট। ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের আশ্রয় গ্রহনের সুযোগের অভাবের বিষয়টিকে পুঁজি করে স্থানীয় প্রভাব বিস্তার করে ভূমিদস্যুরা জায়গা-জমি দখল করে নিচ্ছে। এটা সর্বজনস্বীকৃত বিষয় যে, আদালতের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করা না গেলেও থানার উপর স্থানীয় প্রভাব বিস্তার করার যথেষ্ট সুযোগ থাকে। তাই অসহায় নিপীড়িত গণমানুষের সর্বশেষ আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দু আদালতের কার্যক্রমের ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার কারনে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারের জায়গায় চরম শূন্যতা বিরাজ করছে।
৩. কতিপয় জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিজ্ঞ আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ পূর্বক জামিন লাভের সুযোগ থাকলেও পুলিশী হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য নিজেকে আত্মগোপনে রাখতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া কতিপয় অভিযোগ যেক্ষেত্রে অভিযুক্তের প্রকৃত অবস্থা বিজ্ঞ আদালতের নিকট যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে পারলে হয়তো অভিযুক্তের জামিন লাভের সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে এ সকল ক্ষেত্রে সুযোগের শূন্যতা সৃষ্টি হওয়ায় সংবিধান স্বীকৃত আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। তাহলে আমরা কি নিশ্চিত যে, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে এ ধরনের কোন অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে না যেখানে অফিসার ইনচার্জ পক্ষে মামলা গ্রহণের কথিত স্বেচ্ছাধীন বিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনের ব্যত্যয় ঘটছে না? তাই উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে একটি বিষয় সুস্পষ্ট যে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থার দুটো বিবাদমান পক্ষের মধ্যে অপরাধের শিকার ব্যক্তির আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ। একারণেই যে, আজকে পর্যন্ত দন্ডবিধির বা প্রচলিত অন্য যেকোন ফৌজদারী আইনে নালিশী মামলা দায়েরের কোন সুস্পষ্ট নির্দেশনা মহামান্য সুপ্রীমকোর্টের পক্ষ থেকে পাওয়া যায়নি। মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী যে সকল মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে বিলম্ব হলে তা তামাদি আইনের ৫ ধারার বিধান মোতাবেক মওকুফযোগ্য নয় বিশেষ করে দি নেগোসিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্টের মামলা দায়েরের সুস্পষ্ট নির্দেশনা অনেকটা বিলম্বে হলেও মহামান্য সুপ্রীমকোর্ট থেকে পেয়েছি। তথাপি এন.আই অ্যাক্টের মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে অনেক আইনগত জটিলতার মুখোমুখি ভবিষ্যতে আমাদেরকে হতে হবে এবং এ ধরনের ভবিষ্যত আইনী জটিলতা নিরসনে এ বিষয়ে নতুন আইন প্রনয়ন প্রয়োজন হতে পারে বলে আমি মনে করি।
৪. অপরাধ সংগঠন বা অপরাধের শিকার হওয়ার পর অনতিবিলম্বে সংশ্লিষ্ট থানায় এজাহার বা অভিযোগ দায়ের ব্যর্থতায় এখতিয়ার সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নালিশ দায়েরের বিধান আইনে আছে, এক্ষেত্রে আইনে যথাসম্ভব বিলম্ব এড়ানোর সুস্পষ্ট বিধান আছে এমনকি বিলম্বের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা এজাহার বা নালিশে উল্লেখ করার বিষয়টি আইনে সুনির্দিষ্ট। এজাহার বা নালিশ দায়েরের বিলম্ব এড়ানোর প্রাথমিক দুটি কারণ হলো প্রকৃত ঘটনার Manipulation বা Fabrication করার সুযোগ যাতে না থাকে। তাছাড়া যত দ্রুত সম্ভব সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনার উদঘাটন করার সুযোগ প্রদান। এখন বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে আমার আলোচ্য উল্লেখিত দুটি কারণে যদি কোন ফরিয়াদী সংশ্লিষ্ট থানার মামলা দায়েরে ব্যর্থ হয় বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নালিশ দায়েরের সুযোগ না থাকার কারনে ফরিয়াদী আইনের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ থেকে পুরোপুরিভাবে বঞ্চিত হবে। আইনী বিশ্লেষকরা এর বিপরীতে হয়তো যুক্তি দেখাতে পারেন যে, করোনা পরিস্থিতি নিজেই বিলম্বের একটি যুক্তিসংগত ব্যাখা হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পর মামলা দায়ের হলে ভিকটিমের শারীরিক আঘাতের প্রকৃত অবস্থা (বর্তমানে সুচিকিৎসা প্রাপ্তিতে সংকট বিরাজ করার কারনে) এবং ঘটনাস্থলের প্রয়োজনীয় আলামত ও সাক্ষ্যপ্রমান, যা ন্যায়বিচারের স্বার্থে আদালতের নজরে আনা অত্যাবশ্যকীয় সে বিষয়গুলো নষ্ট বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভবনা রয়েছে যা কোনভাবেই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
৫. ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে হাজতী আসামীর জামিন শুনানী ভার্চ্যুয়ালী হলেও বাস্তবে অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজের জন্য আইনজীবীদের সংশ্লষ্ট আদালতের সেরেস্তায় যেতে হচ্ছে যা ভার্চুয়াল আদালতের মূল উদ্দেশ্য পরিপন্থী।
৬. দরখাস্ত দায়ের ও শুনানীর সুযোগ পাওয়ার ক্ষেত্রে দূর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারনে ভার্চুয়াল আদালতকে আইনজীবী সমাজ ও বিচারপ্রার্থী সাধারণ জনগনের কাছে অগ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
৭. সাপ্তাহিক ছুটির দুইদিনে বিশেষ আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম অপরদিকে সপ্তাহের অবশিষ্ট পাঁচদিনে ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রম পরস্পর সাংঘর্ষিক ও ভার্চ্যুয়াল আদালতের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে।
৮. প্রযুক্তিগত সমস্যার কারনে নিয়মিত আদালত অপেক্ষা ভার্চ্যুয়াল আদালতে তুলনামূলকভাবে কম শুনানী ও সময় স্বল্পতার কারনে বিশেষ মামলাসমূহে আইনি প্রতিকার পাওয়া কষ্টসাধ্য।
আইনজীবীদেরকে সমাজ সংস্কারক হিসাবে প্রথম শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন পেশাজীবীরা যেখানে সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে সর্বস্তরের প্রশংসা অর্জন করেছেন সেখানে সমাজের শৃঙ্খলা ও ন্যায়দন্ড সমুন্নত রাখার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আইনজীবী সমাজের পক্ষে শুধুমাত্র নিজের শারীরিক নিরাপত্তার বিষয় চিন্তা করে সুযোগসন্ধানী অপরাধীচক্রের অপতৎপরতার বিস্তার ও বিচারিক শূন্যতা সৃষ্টির বিরুদ্ধে মৌন থাকার কোন অবকাশ আছে বলে আমি মনে করি না। অন্যান্য পেশাজীবীরা যেভাবে করোনার সাথে যুদ্ধ করে টিকে আছে আমাদেরও সেভাবেই এগিয়ে আসা উচিত।
করোনা পরিস্থিতি এমন কোন বিষয় নয় যে, একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে দেখা যাবে, বিশ্ব তথা দেশ সম্পূর্ন করোনা মুক্ত হয়েছে। এটা এখন স্বীকৃত বিষয় যে, আমাদের করোনাকে সঙ্গে নিয়েই বাঁচতে হবে। যেখানে দেশীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্বিশেষে সকলকে করোনাকে প্রতিহত করার পাশাপাশি নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের আহবান জানিয়েছেন এমনকি আমরা আইনজীবী সমাজ সাধারন জনগনের পাশে থেকে চিকিৎসকদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের দাবীতে আদালতে রীট আবেদন পর্যন্ত দায়ের করেছি সেখানে আইনজীবী সমাজ মহামারী পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমে বিচার ব্যবস্থাকে সীমিত ও কতিপয় ক্ষেত্রে বিচারিক শূন্যতা সৃষ্টিতে মৌন সম্মতি থাকার বিষয়টি সামাজিক অপরাধ ও অবক্ষয় রোধে আইনজীবীদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
উল্লেখিত পরিস্থিতিতে আমার ব্যক্তিগত প্রস্তাবনা সমূহ নিম্নরুপ যা চলমান সংকট নিরসনের নিমিত্তে বাস্তবায়নের জন্য বিবেচনা করা যেতে পারেঃ-
- অতীব প্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় ক্ষেত্র ব্যতীত বিচারপ্রার্থী পক্ষগনের আদালতে উপস্থিতি ব্যতিরেকে এবং ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি প্রদানপূর্বক বিচারিক কার্যধারার মূলতবী রাখার উপযুক্ত বিষয়সমূহ মূলতবি রেখে অন্যান্য সকল জরুরি বিষয়সমূহ স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে প্রতিপালন সাপেক্ষে শুনানীর নিমিত্তে নিয়মিত আদালত চালু করা।
- দেশের বৃহত্তর স্বার্থে নিয়মিত আদালত চালু করা কোনভাবেই সম্ভব না হলে আপাতদৃষ্টিতে বেআইনী উপায়ে নির্দোষ ব্যক্তির বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এজাহার বা জামিনযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সনাক্ত মতে আত্মসমর্পণ পূর্বক জামিনের আবেদনের সুযোগ সৃষ্টি করে প্র্যাকটিস নির্দেশনা প্রনয়ন, যেখানে বিজ্ঞ আদালত পূর্ণ বা অন্তবর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করতে পারেন অথবা বিজ্ঞ আদালত যদি জামিন দেওয়ার জন্য সন্তুষ্ট না হন তবে সেক্ষেত্রে আবেদন Not pressed বা Return করতে পারেন।
- ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে নালিশী মামলা গ্রহণ করে ক্ষেত্রমত তদন্ত বা এফআইআর গ্রহণের আদেশ দিতে পারেন।
- ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৪ ধারামতে সংবাদ এন্ট্রি করার নির্দেশ প্রদান করতে পারেন।
- অন্যান্য যে সকল দরখাস্ত সমূহ ভার্চুয়ালি করা সম্ভব সেগুলো জরুরী বিবেচনায় শুনানীর নির্দেশ প্রদান করতে পারেন।
- বিজ্ঞ নিম্ন আদালতের আসামীর জামিনের বা যে কোন দরখাস্ত নামন্জুরের আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে শুধুমাত্র নিয়োজিত আইনজীবীর হলফনামা প্রদান সাপেক্ষে মামলার যাবতীয় কাগজপত্র ও বিজ্ঞ নিম্ন আদালতের নামন্জুর আদেশের আইনজীবী কর্তৃক সত্যয়নকৃত ফটোকপির ভিত্তিতে মামলার গুনাগুনের উপর সিদ্ধান্ত প্রদানের নির্দেশ দিতে পারেন। তবে এক্ষেত্রে মামলায় যে কোন ভূল বা অসত্য তথ্য উপস্থাপনের দায় নিয়োজিত হলফকারী আইনজীবীর উপর বর্তাইবে এবং পেশাগত অসদাচরণ গন্যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচিত হইবে এবং ভূল বা অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রদত্ত আদেশ বাতিলযোগ্য হবে।
- ভার্চ্যুয়াল আদালতের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যাতে কোন পক্ষ ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত না হয় যেমন নালিশী মামলায় উভয় পক্ষকে শুনানী করার সুযোগ দান আবশ্যক হলে এরুপ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে শুনানীর বিধিমালা রেখে প্র্যাকটিস নির্দেশনা জারির ব্যবস্থা করতে পারেন।
- সর্বোপরি ভার্চ্যুয়াল আদালতকে সেমি-ভার্চ্যুয়াল এর পরিবর্তে শতভাগ ভার্চ্যুয়াল করার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল আদালতের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য পূরনের ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেন।
উল্লেখিত বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন করতে পারলেই দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে নিয়মিত আদালত চালুর অপারগতায় অগত্যা ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমে সংবিধান স্বীকৃত আইনের আশ্রয় লাভের নাগরিক অধিকার সমুন্নত রাখা যাবে বলে আমি মনে করি।
লেখকঃ অ্যাডভোকেট; জজকোর্ট, চট্টগ্রাম।