মোকাররামুছ সাকলান: মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে কেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমিতি তরবারী উপহার দিলো এ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। আলোচনাটি বেশি হচ্ছে কারণ মাননীয় প্রধান বিচারপতি এই উপহারটি গ্রহণ করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান জনাব হারুন-অর-রশিদ সাহেবের কাছ থেকে।
নিশ্চয়ই আপনারা ইতিমধ্যে জেনেছেন যে, জনাব হারুন-অর-রশিদ সাহেব বৃহত্তর ময়মনসিংহ সমিতির মহাসচিব। আর অন্যদিকে মাননীয় প্রধান বিচারপতি জনাব ওবায়দুল হাসান নেত্রকোনা জেলায় জন্মগ্রহণকারী একজন কৃতি সন্তান। নেত্রকোণা জেলা ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত।
১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি নেত্রকোণা মহকুমাকে জেলা ঘোষণা করা হয়। (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জারিকৃত প্রজ্ঞাপন নম্বর-এস-আর, ও ১৭-এল/৮৪/এম,ই,আর(জ,এ-২)/২৬৪/৮৩-৩০)। একই খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে নব প্রতিষ্ঠিত জেলার কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে এই জেলা ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিলো।
ময়মনসিংহ অঞ্চলে মোঘল আমলে বাংলার বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন বাংলার বিখ্যাত ১২ ভূঁইয়ার প্রধান মসনদ-ই-আলা ঈসা খাঁ (১৫৩৬ – ১৫৯৯ খৃঃ)। ঈশা খাঁর বীরত্ব ৪০০ বছর ধরেই এদেশের জনগনের মুখে মুখে রয়েছে। ঈসা খাঁ মোঘল সেনানায়ক মানসিংকে লড়াইয়ে হারিয়ে তিনি বাংলার স্বাধীনতাঁকে অক্ষুণ রেখেছিলেন।
এই লড়াই যেখানে হয়েছিল সেটি ছিল ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের টাঙ্গাব গ্রামে। স্থানটি শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে। নদীর পূর্ব তীরে ছিল রাজা মানসিংয়ের রাজধানী টোক নগরী (বর্তমানে কাপাসিয়া উপজেলার উত্তর পূর্বাংশ)। মানসিং ১৫৯৫ সালে রাজস্থান থেকে তার রাজধানী টোক নগরীতে স্থানান্তর করে নিয়ে আসে। ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যার সঙ্গমস্থলে ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ তীরে ছিল টাঙ্গাব গ্রাম ও টোক নগর। ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে ঈসা খাঁর বিখ্যাত দুর্গ এগারসিন্দুর। এটি পড়েছে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায়।
ইতিহাস অনুযায়ী গফরগাঁওয়ের টাঙ্গাব গ্রামে ঈশা খাঁ-মানসিংয়ের যুদ্ধ হয়েছে ৪২০ বছর আগে। ঈশা খাঁর অনুপস্থিতিতে মানসিংহ আক্রমণ করেন ঈশা খাঁর দুর্গ এগারসিন্দুর। সংবাদ পেয়ে ঈশা খাঁ দুর্গ রক্ষায় ছুটে আসেন। কিন্তু তার সৈন্যরা এতই ক্লান্ত ছিল যে, তারা যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ঈশা খাঁ মানসিংহকে একক যুদ্ধের আহ্বান জানান।
ওই লড়াইয়ের আগে ঠিক হয়, যিনি যুদ্ধে জয়ী হবেন তিনিই বাংলার কর্তৃত্ব লাভ করবেন। মানসিংহ এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলে শুরু হয় লড়াই। প্রথম দিনের লড়াইয়ে মানসিংহ নিজে না এসে অজ্ঞাতনামা এক যুবককে পাঠান। যুবক ছিলেন মানসিংহের জামাতা। ঈশা খাঁ তাকে চিনতে পারেন এবং যুদ্ধে যুবকটির মৃত্যু হয়। ঈশা খাঁ এরপর মানসিংহকে তার ধিক্কার দিয়ে ফিরে আসেন। এতে মানসিংহ নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে আসেন এবং ঈশা খাঁর সঙ্গে তুমুল লড়াই হয়।
একপর্যায়ে মানসিংহের তরবারি ভেঙ্গে গেলে ঈশা খাঁ তাকে আঘাত না করে নিজের তরবারি মানসিংহকে দেন। কিন্তু মানসিংহ তরবারি না নিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে আসেন। ঈশা খাঁ তখন মানসিংহকে মল্লযুদ্ধে আহ্বান করেন। কিন্তু মানসিংহ তা গ্রহণ না করে ঈশা খাঁকে আলিঙ্গন করেন। তার সাহস ও মহানুভবতায় মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন।
মানসিংহ শিবিরে ফিরে গেলে তার রানী তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন, মোগল সম্রাট আকবর এই ঘটনায় মানসিংহকে হত্যা করবেন এবং তিনি বিধবা হয়ে যাবেন।
এরপর ঈশা খাঁ নিজেই এই সমস্যা সমাধান করেন। তিনি মানসিংহের সঙ্গে সম্রাট আকবরের দরবারে যেতে রাজি হন। সেখানে গেলে ঈশা খাঁকে বন্দী করেন সম্রাট। পরে মানসিংহের কাছে সব কথা শুনে তিনি ঈশা খাঁকে ২২ পরগণায় আধিপত্য ও মসনদ-ই আলী উপাধিতে ভূষিত করে স্বদেশে ফেরত পাঠান।
ঐতিহাসিকভাবে এই ঈশা খাঁর তরবারী ময়মনসিংহ অঞ্চলের জন্য এক ঐতিহ্য। আমাদের দেশে ইতিহাস ঐতিহ্যকে মুছে দিয়ে যেকোন ঘটনাকে এক ধরনের বাজে রঙ দেওয়া হয়। তার প্রমাণই হয়তো এই সমালোচনা। শুভেচ্ছা স্মারক হিসাবে এই তরবারী ঐতিহাসিক এবং আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য বহন করে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: তথ্যসমূহ অনলাইনে বিভিন্ন পেইজ হতে সংগৃহীত।
লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।