ধর্ষণের বিচার কঠিন কেন, ব্যাখ্যা দিলেন নারী বিচারপতি

প্রতিবেদক : ল'ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ
প্রকাশিত: ১২ মে, ২০১৮ ১:৪৪ অপরাহ্ণ
রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ‘যৌন সন্ত্রাসবিরোধী গণকনভেশন’

আর্থ-সামাজিক বাধা ও রাষ্ট্রীয় নানা অব্যবস্থাপনার কারণে বহু ধর্ষিত নারী যে বিচারের বাইরে থাকছেন নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন হাই কোর্টের এক নারী বিচারপতি।

রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ‘যৌন সন্ত্রাসবিরোধী গণকনভেশনের’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গতকাল শুক্রবার (১১ মে) বিচারপতি জিনাত আরা বলেন, “ধর্ষণের ভিকটিমদের মধ্যে দেখা যায়, তারা মনে করে অপবিত্র হয়ে গেছে, যে কারণে সাথে সাথে বার বার গোসল করতে থাকে। এর জন্য অনেক ক্ষেত্রে ডিএনএ টেস্টের সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না।

“আমাদের এখানে ডিএনএ টেস্ট সব জায়গায়তে সঠিকভাবে করাও হয় না। সাথে সাথে ডাক্তারি পরীক্ষাও করা হয় না। গেলেও অনেক সময় দেখা যায় ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ব্যক্তিদের চাপে সঠিক রিপোর্ট অনেক ক্ষেত্রে আসে না।”

ধর্ষণের মামলা আদালতে যাওয়ার আগে আরও বেশ কিছু বাধা ও সমস্যার চিত্র তুলে ধরেন এই বিচারপতি।

তিনি বলেন, “দেখা যায় প্রথমে গ্রামের লোকজন বাধা দেয় যাতে মামলা না করা হয়। আর যদি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল হয় তাহলে মামলা দায়েরের পূর্বে অথবা পরে টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে ফেলে। তারপরও যেটা হয় উনারা কোর্টে এসে সাক্ষ্য দেন না।
“তখন সাক্ষী না থাকায় বিচারকরা অনুমানের ওপর শাস্তি দিতে পারেন না। বিচারকালে আমাদেরকে এসব প্রচুর সমস্যা ফেইস করতে হয়।”

তবে ধর্ষণ নিয়ে প্রচুর মিথ্যা মামলা হয়ে থাকে এবং আইনগত কারণে অনেক ধর্ষণের ঘটনার বিচার হয় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

নারীরা প্রায় সব পরিবেশে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে মন্তব্য করে জিনাত আরা বলেন, “নারী নির্যাতন বন্ধে আগে নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে। পুত্র ও কন্যা সন্তানকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। স্কুলে মেয়েদের আত্মরক্ষার নিয়ম শিখাতে হবে। জনগণকে সচেতন করতে হবে। নারী ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিষয়ে আইন ও শাস্তি সম্পর্কে সবাইকে জানাতে হবে।”

যৌনসন্ত্রাস বিরোধী গণ কনভেনশন প্রস্তুতি কমিটির এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কমিটির আহ্বায়ক ডা. লেলিন চৌধুরী।

এতে খেলাঘরের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারপার্সন ও ডাকসুর সাবেক ভিপি অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, “এক সময় নারী পুরুষের অধিকার সমান ছিল। সমাজতান্ত্রিক দর্শনে নারীকে সম্মান ও মানবিকভাবে দেখা হত। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সাম্রাজ্যবাদ দর্শনে নারীকে পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। নারীদের ওপর যে মনোভাব তা আন্তর্জাতিক অবস্থা থেকে বাংলাদেশের ওপর পড়েছে।

“তবে আমরা এমন একটি বাংলাদেশ দেখতে চাই, যে দেশে নারী পুরুষ-সমান থাকবে। যৌন সন্ত্রাসীরা বিকৃত রুচির মানুষ তাদের বিভিন্নভাবে চিকিৎসা দিতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে।”নারী আন্দোলনের নেত্রী রোকেয়া কবীর বলেন, “যৌনসন্ত্রাস ও যৌন নির্যাতন শুধু বাংলাদেশে নই, তা সাড়া বিশ্বে ঘটছে। যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আমাদের যে যুদ্ধ এটি কঠিন যুদ্ধ, এই যুদ্ধে আমাদের জয় হতেই হবে।”

অনুষ্ঠানে গণধর্ষণের শিকার এক আদিবাসী নেত্রী বলেন, “ভূমি দস্যূদের হাত থেকে আমার স্বামীর জমি রক্ষা করার আন্দোলনে গিয়ে আমি গণধর্ষণের শিকার হয়েছি। ৭১ এ লক্ষ লক্ষ মা-বোন ধর্ষিত-নির্যাতিত হয়েছে তারা বিচার পায়নি, আমিও বিচার পাইনি।

“এভাবে বিচারহীনতা চলতে থাকলে দেশের প্রতিটি মা-বোন ধর্ষণের শিকার হবে। আমরা আর মুখ বন্ধ করে সহ্য করব না, সকল ধর্ষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।”

কনভেনশনের দ্বিতীয় পর্বে ‘নিজেরা করি’ সংগঠনের সমন্বয়ক খুশি কবিরের সভাপতিত্বে এক সেমিনারে ‘যৌনসন্ত্রাস: সংকট ও উত্তরণ’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ডা. লেনিন চৌধুরী।

আলাচনায় অংশ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাসিম আখতার হুসাইন বলেন, “আর যদি একটি নারী আক্রান্ত হয় তাহলে মনে করব আমরা সবাই আক্রান্ত হয়েছি, তাহলে নারীর ওপর নির্যাতন-সন্ত্রাস আমরা নিপাত করতে পারব।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বলেন, “আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে নারী আজ যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমরা দেখছি অপরাধীর একটা রাজনৈতিক পরিচয় থাকে, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের লোকেরা অপরাধে জড়িয়ে যায়। প্রধান রাজনৈতিক দলের উঁচু থেকে নিচু পর্যায়ের ব্যক্তিরা বড় ধরণের অপরাধী।

“যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে মানুষকে যেমন সচেতন হওয়ার দরকার, তেমনি এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সজাগ হতে হবে।” বিডিনিউজ