অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা, ভোক্তা অধিকার ও আইনি প্রতিকার

ফাইজুল ইসলাম: একবিংশ শতাব্দীতে তথ্য-প্রযুক্তি বিপ্লবের কারণে সারাবিশ্বে ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ঘরে বসে অফিস-আদালতের কাজের পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সকল ধরণের পণ্য হাতে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে ই-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। করোনা মহামারীর সংকটকালে যা আরও বেশি ব্যাপ্তি লাভ করেছে। তবে এতো সুযোগ মানুষের মধ্যে স্বস্তি যেমন এনেছে, প্রতারণার কারণে ভোক্তারা ভোগান্তিতেও পরেছেন। তেমন কিছু উদাহরণ দিয়ে আজকের আলোচনা শুরু করতে চাই-
১. ফারুক সাহেব নামমাত্র একটি অনলাইন শপে বাচ্চার জন্য ২ হাজার টাকায় একটি খেলনা অর্ডার করলেন, অগ্রীম টাকাও প্রদান করলেন। টাকা পাওয়ার পরই অনলাইন শপ তার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেন।
২. নাকিবা জান্নাত হিয়া অনলাইনে কিছু বিউটি প্রোডাক্টস অর্ডার করলেন। তিনিও অগ্রীম টাকা পরিশোধ করলেন।টাকা নিয়েও অনলাইন শপ তার পণ্যগুলো দিচ্ছে না।
৩. জসীম উদ্দিন হলের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আনন্দ পাল অনলাইনে রিয়াল মাদ্রিদের প্লেয়ার এডিশনের জার্সি অর্ডার করলেন। কিন্ত অনলাইন শপটি তাকে লোকাল এডিশনের জার্সি দিল।
উপরোক্ত তিনটি ক্ষেত্রেই ভোক্তা অধিকার বঞ্চিত হয়েছেন তথা প্রতারিত হয়েছেন। মূলত এই প্রতারণাগুলো নিত্যদিন আমাদের চারপাশে ঘটে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হওয়ার পরে প্রতিকার পেতে তেমন কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়না। দৈনন্দিন ব্যস্তময় জীবনে আমাদের প্রতিনিয়তই অনলাইনের উপর নির্ভর করতে হয়। এই সুযোগকেই কাজে লাগায় একদল দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী নামের প্রতারকরা। অনলাইনে কেনাকাটা করতে গিয়ে অনেকে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। হরহামেশাই শোনা যায় ফেসবুক কিংবা কোনো গ্রুপের পেজে পণ্য অর্ডার দেওয়া হয়েছিলো। আগাম অর্থ নিয়ে তারা উধাও হয়ে গেছে। আবার অনেক সময় অনলাইনে যে মানের পণ্য অর্ডার দেওয়া হয়েছিলো তার চেয়ে তার চেয়ে নিম্ন মানের পণ্য ক্রেতার কাছে পৌঁছানো হয়েছে।
এ রকম প্রতারণার কথা প্রায়ই শোনা যাচ্ছে। কেউ এ রকম প্রতারণায় পড়লে আইনি সহায়তা নিতে পারবেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারিত হলে আইনি কি প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে।
একজন বিবেকবান নাগরিক হিসেবে যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে সচেতনতাই সর্ব উৎকৃষ্ট পন্থা। আইনে ‘ক্রেতা সাবধানতা নীতি’ বা ক্যাভিয়েট এম্পটর একটা মতবাদ আছে। যেখানে ক্রেতাকে প্রতারণার শিকার হতে রক্ষার জন্য সচেতনতার উপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
Caveat Emptor বা ক্রেতা সাবধান নীতি বলতে কি বুঝায়?
Caveat Emptor একটি ল্যাটিন শব্দবদ্ধ যার আক্ষরিক অর্থ- ‘Let the buyer beware’ ক্রেতাকে সতর্ক হতে দাও। ইংল্যান্ডের আদালত বহু বছর ধরে এই মতবাদটি অনুসরণ করে আসছে।
বাণিজ্যিক লেনদেনে প্রতিটি ক্রেতাকে পণ্য কেনার সময় সাবধান হতে হবে। কেণনা, Sales of Goods Act,1930 ধারা ১৬ অনুযায়ী বিক্রেতা তার পণ্যের দোষ প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। পণ্যের গুণাগুণ ও উপযোগিতা ভাল করে যাচাই করে নেয়া ক্রেতার কর্তব্য। বিক্রয়ের পর তা ধরা পড়লে বিক্রেতা তা ফেরত নিতে বাধ্য নয়। এজন্য ক্রেতাকে সাবধানে পণ্য ক্রয় করতে বলা হয়েছে। এই মতবাদকে ‘ক্রেতা সাবধান’ (caveat emptor) মতবাদ বলা হয়।
উদাহরণ:
মোজাম্মেল তার মোটর গাড়ী বিক্রয়ের প্রস্তাব রবিউলের এর নিকট করে। মোজাম্মেল জানে যে তার গাড়ীর ইঞ্জিনে সমস্য আছে, সে তা রবিউলের নিকটে প্রকাশ করেনি। রবিউল সাথে একটি মোটর মিস্ত্রি নিয়ে আসে। মিস্ত্রী গাড়ীটি পরীক্ষা করে চালায়ে দেখে এবং গাড়ীটি খরিদ করে নিয়ে যায়। রবিউল পরের দিন গাড়ীর ইঞ্জিনে সমস্যা আছে বুঝতে পারে এবং মোজাম্মেল প্রতারণা করেছে এই অভিযোগে চুক্তিটি বাতিল করতে চায়।
এক্ষেত্রে ক্রেতা যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করেছে এবং একজন মোটর মিস্ত্রি দ্বারা গাড়ীটি পরীক্ষা করে নিয়েছে। এতদসত্ত্বেও গাড়ীটি ক্রয় করার পর আর তা বাতিল করা যায় না। এছাড়া মোজাম্মেল কখনো বলে নাই যে, তার গাড়ীটি দোষমুক্ত কিংবা সে কোন প্রতারণার আশ্রয় নেয় নাই। মিথ্যা বর্ণনা বা প্রতারণার প্রমাণ থাকলে চুক্তিটি বাতিলযোগ্য হতো। কিন্তু সে সকল উপাদানও এক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তাই কোন ক্রমেই ‘রবিউল চুক্তিটি বাতিল করতে পারে না।
কি করবেন ক্রেতা?
ক্রেতা যদি অনলাইন কিংবা অফলাইনের প্রতারণার শিকার হন তাহলে আইনের আশ্রয় নেওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালতে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ ক্ষতিপূরণের মামলা করা যেতে পারে; ফৌজদারি আদালতে ৪২০ ধারার আওতায় প্রতারণার মামলা করা যেতে পারে। সেলস অব গুডস এক্ট ১৯৩০ অথবা কনজিউমার প্রোটেকশন এক্ট এর অধীনে অথবা ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা ২০২১ এর অধীনে প্রতিকার পেতে পারেন।
কী করলে হবে প্রতারণা
সাদামাটা অর্থে কেউ কারও সঙ্গে কোনো বিষয়ে যদি যেকোনো ধরনের মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং কোনো প্রতিশ্রুতি ভেঙে ফেলে, সে, ক্ষেত্রে প্রতারণা বলা হলেও আইন অনুযায়ী প্রতারণার সংজ্ঞা কিছুটা ভিন্ন। আইন অনুযায়ী যে ব্যক্তি, কাউকে ফাঁকি দিয়ে প্রতারণামূলকভাবে বা অসাধুভাবে কোনো ব্যক্তির কাছে কোনো সম্পত্তি প্রদানে বা রাখতে প্ররোচিত করে, তাহলে হবে প্রতারণা। ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতারিত ব্যক্তিকে এমন কোনো কাজ করতে বা তা করা থেকে বিরত থাকতে প্ররোচিত করে। যার ফলে ব্যক্তির শরীর, মন বা সম্পত্তির ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তাহলে সেটি প্রতারণা হবে। যদিও আইনে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
প্রতারণার প্রকারভেদ
অনেক রকম প্রতারণা আছে। যেমন-
১. ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে প্রতারণা,
২. জালিয়াতি করে প্রতারণা,
৩. মিথ্যা পরিচয় প্রদান করে প্রতারণা (পেনাল কোড ধারা ৪১৭) ,
৪. বিয়ে নিয়ে প্রতারণা প্রভৃতি।
আলাদা আলাদা প্রতারণার অভিযোগে আলাদা আলাদা শাস্তি নির্ধারিত আছে। সাধারণত দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় মামলা বেশি হতে দেখা যায়। এ ধারায় শাস্তি সর্বোচ্চ ৭ বছর এবং পাশাপাশি অর্থদণ্ডেরও বিধান আছে।
আইনের আশ্রয় কীভাবে নেবেন
দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ধারা-৪২০: প্রতারণা ও অসাধুভাবে সম্পত্তি অর্পণ করতে প্রবৃত্ত করা (Cheating and dishonestly delivery of property):
যদি কোন ব্যক্তি প্রতারণা করে এবং প্রতারিত ব্যক্তিকে অসাধুভাবে অন্য কোন ব্যক্তিকে কোন সম্পত্তি প্রদানে প্রবৃত্ত করে কিংবা প্রতারিত ব্যক্তিকে কোন মুল্যবান জামানতের সমুদয় অংশ বা অংশবিশেষ কিংবা মূল্যবান জামানতে রূপান্তরযোগ্য কোন স্বাক্ষরিত বা সীলমোহরযুক্ত বস্তুর সমুদয় অংশ বা অংশবিশেষ প্রণয়ন, পরিবর্তন বা বিনাশ সাধনে প্রবৃত্ত করে, তবে উক্ত ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত যেকোন মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তাকে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা যাবে।
যেকোনো কারণে প্রতারণার শিকার হলে কিংবা চাকরির নামে কোনো প্রতারণার শিকার হলে, এমনকি অনলাইনে হলেও আইনের আশ্রয় খুব সহজেই নিতে পারেন। আপনি দায়ী ব্যক্তি বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করতে পারেন। প্রতারণার পাশাপাশি বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগও আনা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে দেওয়ানি আদালতে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারেন। তবে আইনের আশ্রয় নিতে চাইলে যথেষ্ট প্রমাণাদি থাকা লাগবে। যেমন কোনো লিখিত চুক্তি, কোনো রসিদ—এসব বিষয়। তাই এ দলিলগুলো সংরক্ষণ রাখা জরুরি।
থানায় এজাহার দায়ের করে মামলা করা যায় অথবা আদালতে সরাসরি মামলা দায়ের করা যায়। এ মামলা দায়ের করতে হয় মুখ্য বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বা মহানগর এলাকা হলে মুখ্য মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে।
দণ্ডবিধি ছাড়া অন্যান্য প্রতিকার
দ্যা সেলস অফ গুডস অ্যাক্টস এর আওতায় প্রতিকার পাওয়া যায়; চুক্তি আইনে প্রতিকার পাওয়া যায়; প্রতিটি জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে।
তবে বর্তমান সামগ্রিক দিক পর্যালোচনায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করাটাই সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা।
ভোক্তা অধিকার আইনে প্রতিকার
ভোক্তা অধিকারের এই নির্দেশনাগুলো অনলাইনে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রেও কার্যকর
পণ্যের মোড়ক, ইত্যাদি ব্যবহার না করার দণ্ড
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৩৭ নম্বর ধারায় বলা আছে, কোনো ব্যক্তি কোনো আইন বা বিধি দ্বারা কোনো পণ্য মোড়কাবদ্ধভাবে বিক্রয় করার এবং মোড়কের গায়ে সংশ্লিষ্ট পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, ব্যবহার-বিধি, সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয় মূল্য, উৎপাদনের তারিখ, প্যাকেটজাতকরণের তারিখ এবং মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ স্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে থাকলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাকে প্রতারিত করার দণ্ড
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৪৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করার দণ্ড
আইনের ৪৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
অপরাধের পুনরাবৃত্তির দণ্ড
৫৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনে উল্লিখিত কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত ব্যক্তি যদি আবারও একই অপরাধ করেন তবে তিনি উক্ত অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ যে দণ্ড রয়েছে তার দ্বিগুণ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
বিচার প্রক্রিয়া
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯-এর ৬০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি কারণ উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে এই আইনের অধীন ভোক্তা অধিকার বিরোধী কাজ সম্পর্কে মহাপরিচালক কিংবা অধিদপ্তরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার নিকট অভিযোগ না করলে ওই অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না।
অভিযোগ এবং জরিমানার টাকায় অভিযোগকারীর অংশ
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৭৬(৫) ধারা অনুযায়ী, আদালত বা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নিয়মিত ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হলে এবং নিয়মিত মামলায় অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে জরিমানা করা হলে এবং জরিমানার অর্থ আদায় করা হলে, তার ২৫ শতাংশ অর্থ উপধারা (১)-এ উল্লেখিত অভিযোগকারীকে প্রদান করতে হবে।
অধিদপ্তরে অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার সত্যতা নিরূপণে দুই পক্ষ থেকে শুনানি শেষে সংশ্লিষ্ট অনলাইন প্রতিষ্ঠানকে জরিমানার আদেশ দিবেন। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জরিমানার টাকা আদায় শেষে ২৫ শতাংশ টাকা ক্ষতিগ্রস্ত ভোক্তা বা ক্রেতাকে প্রদান করা হবে।
ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১
ডিজিটাল কমার্স পরিচালনায় স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে ক্রেতা-বিক্রেতাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ২০২০ সালের ‘জাতীয় ডিজিটাল কমার্স পলিসি’ সংশোধন করে ২০২১ সালের ৪ জুলাই ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১’ প্রণয়ন করা হয়। এতে অনলাইনে ব্যবসা পরিচালনা ও কেনাকাটার বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া আছে।
অনলাইন কেনাকাটায় কোনটি ভোক্তার অধিকার আর কোনটি প্রতারণা সে বিষয়টি পরিষ্কার করতে ‘ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১’-এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা তুলে ধরা হলো।
অনলাইন পণ্য সরবরাহের নিয়মাবলী
ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১-এ বলা হয়েছে, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পণ্য ডেলিভারিম্যান বা ডেলিভারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর করতে হবে এবং ক্রেতাকে তা টেলিফোন, ই-মেইল অথবা এসএমএসের মাধ্যমে জানাতে হবে।
পণ্যের সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করা হয়ে থাকলে ক্রেতা ও বিক্রেতা একই শহরে অবস্থান করলে ক্রয়াদেশ গ্রহণের পরবর্তী সর্বোচ্চ পাঁচ দিন এবং ভিন্ন শহরে বা গ্রামে অবস্থিত হলে সর্বোচ্চ ১০ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারি করতে হবে।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে ডেলিভারির সময় আরও সংক্ষিপ্ত হবে এবং ক্রেতাকে তা ক্রয়াদেশ গ্রহণের সময় সুস্পষ্টভাবে অবহিত করতে হবে।
একটি ক্রয়াদেশে একাধিক পণ্য থাকলে আলাদা আলাদা পণ্যের জন্য সাধারণত আলাদা আলাদা ডেলিভারি চার্জ আরোপ করা যাবে না। তবে, মার্কেটপ্লেসে পণ্যে আলাদা আলাদা ডেলিভারি প্রদান করা হলে আলাদা আলাদা চার্জ গ্রহণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ক্রেতাকে ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করার সময় বা ইনভয়েসে আগেই জানাতে হবে।
পণ্য সরবরাহের সময় মুদ্রিত বিল প্রদান করতে হবে, যাতে প্রদেয় বা প্রদত্ত ভ্যাট ও আয়কর (যদি থাকে) উল্লেখ থাকতে হবে।
অগ্রিম পরিশোধিত মূল্য প্রদান হলে
ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১-এ বলা হয়েছে, ক্রেতা কোনো মাধ্যমে (ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক ট্রান্সফার, মোবাইল ব্যাংকিং ও অন্যান্য) অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করলে এবং বিক্রেতা কোনো কারণে নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হলে মূল্য পরিশোধের সর্বোচ্চ ১০ দিনের (সংশ্লিষ্ট অর্থ প্রদানকারী মাধ্যমের ব্যবহৃত সময় ব্যতীত) মধ্যে ক্রেতার পরিশোধিত সম্পূর্ণ অর্থ যে মাধ্যমে ক্রেতা অর্থ পরিশোধ করেছে সেই একই মাধ্যমে (ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, ব্যাংক ট্রান্সফার, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদি) ফেরত দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো চার্জ থাকলে মার্কেটপ্লেস বা বিক্রেতাকে তা বহন করতে হবে। মূল্য ফেরতের বিষয়ে ক্রেতাকে ই-মেইল, এসএমএস, ফোন বা অন্য মাধ্যমে অবহিত করতে হবে। তবে, এ ক্ষেত্রে ক্রেতার পরিশোধিত মূলের অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা যাবে না। ক্রেতা যথাসময়ে পণ্য বা সেবা গ্রহণে ব্যর্থ হলে এ সময়সীমা শিথিল করা যাবে।
যেকোনো ধরনের ঘোষিত ডিসকাউন্ট বিক্রয় কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করতে হবে। ক্যাশব্যাক অফার মূল্য পরিশোধের পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর হতে হবে।
ক্যাশব্যাক অফার বা মূল্যছাড় অফারের ঘোষিত অর্থ সংশ্লিষ্ট পণ্য বা সেবা বিক্রয় সম্পন্ন হওয়ার পর কোনো ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানের ওয়ালেটে জমা রাখা যাবে না।
মার্কেটপ্লেসে কীভাবে পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের জন্য উপস্থাপন করতে হবে
নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, মার্কেটপ্লেসে (ইন্টারনেটে এক ধরনের ডিজিটাল কমার্স সাইট বা পোর্টাল। যেখানে এক বা একাধিক তৃতীয় পক্ষ পণ্য সম্পর্কিত তথ্য সন্নিবেশ করে থাকে এবং লেনদেন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে থাকে) বিক্রয়যোগ্য পণ্য বা সেবার যথাযথ বিবরণ, যেমন: পণ্যের পরিমাণ, উপাদান, রং, আকৃতি, গুণগত মান ইত্যাদি মূল্য এবং ডেলিভারিসহ অন্যান্য চার্জ যদি থাকে তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। পণ্য বা সেবাকে চিহ্নিত করার জন্য পরিপূর্ণ বর্ণনা, যা পণ্য বা সেবাকে চিহ্নিত করতে সক্ষম এমন তথ্যাদি প্রদান করতে হবে।
সুস্পষ্টতার জন্য বাস্তবসম্মত হলে পণ্যের ছবি, ভিডিও, রং, আকৃতি, পরিমাপ, ওজন ও উপাদান ইত্যাদি এবং সেবার ক্ষেত্রে সেবার ধরন, সেবা প্রদান পদ্ধতি, পরিমাপ যোগ্যতা (যদি থাকে) ইত্যাদি তথ্য প্রদান করতে হবে। পণ্যের বিস্তারিত বিবরণ (ব্র্যান্ড, মডেল, ডেলিভারি সময় ইত্যাদি) ক্রেতাদের জন্য দিতে হবে, যাতে ক্রেতা জেনে-বুঝে পণ্য বা সেবা ক্রয় করতে পারে।
বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত পণ্য বিক্রেতা বা তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে এবং বিজ্ঞপ্তিতে কী পরিমাণ পণ্য স্টকে রয়েছে তা উল্লেখ করতে হবে এবং প্রতিটি বিক্রয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই পণ্যের স্টক হালনাগাদ করতে হবে। বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শিত পণ্য বিক্রেতা বা তার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে না থাকলে ‘স্টকে নেই’ বা ‘আউট অব স্টক’ কথাটি স্পষ্টভাবে পণ্যের পাশে লিখে রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পেমেন্ট গ্রহণ করা যাবে না।
অগ্রিম মূল্য আদায়ের ক্ষেত্রে প্রদর্শিত পণ্য অবশ্যই দেশের ভেতরে ‘রেডি টু শিপ’ মার্কেটপ্লেসের নিজস্ব নিয়ন্ত্রণে বা মার্কেটপ্লেসে নিবন্ধিত থার্ড পার্টি (বিক্রেতার নিয়ন্ত্রণে) পর্যায়ে থাকতে হবে। সম্পূর্ণ মূল্য গ্রহণের পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডেলিভারি পারসন বা প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থায় নেই এমন পণ্যের ক্ষেত্রে পণ্যমূল্যের ১০ শতাংশের বেশি অগ্রিম গ্রহণ করা যাবে না। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত এসক্রো সার্ভিসের মাধ্যমে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত অগ্রিম গ্রহণ করা যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী; আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।