অধস্তন আদালতে একটি মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূতভাবে অর্থ লেনদেন হয়। মামলার ধরন, গুরুত্ব, বিবাদী বা আসামির সংখ্যা, কাজের অত্যাবশ্যকীয়তা, বিচারপ্রার্থীর সামর্থ্য ও এলাকার ওপর নির্ভর করে এই ঘুষের পরিমাণ ২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণায় অধস্তন আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে এই ঘুষ বা নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেনের তথ্য উঠে এসেছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে ধানমন্ডির কার্যালয়ে টিআইবি এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
গবেষণায় দেখা যায়, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাক্ষীর শুনানি, জেরার সময় ভূমিকা না রাখা ও মামলা আপস বা প্রত্যাহারের জন্য নিম্নে ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেন। একইভাবে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থানায় পাঠানো, ওকালতনামা শনাক্ত, নথি উত্তোলনসহ বিভিন্ন কাজে কোর্ট পুলিশকে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া জামিন প্রদান ও নিষেধাজ্ঞা জারির আদেশ প্রভাবিত করতে ২০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়।
এ ছাড়া দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলায় বিভিন্ন কাজের জন্যও ঘুষ লেনদেন হয়। এর মধ্যে দেওয়ানি মামলায় আরজি দাখিলে ২০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা, আরজি সংশোধনের জন্য ১০০ থেকে ৩০০ টাকা, শুনানির দিন হাজিরার জন্য সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা, শুনানির তারিখ নির্ধারণে (সময় বাড়ানো বা এগিয়ে নেওয়া) ১০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা, সমন জারির জন্য সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা, সাক্ষীর জেরা ও জবানবন্দির কপি তুলতে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।
একইভাবে ফৌজদারি মামলার ফাইলিং (সিআর মামলার ক্ষেত্রে) ২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা, মামলা আমলে নেওয়ার পর নোটিশ জারির জন্য সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা, পরোয়ানা দ্রুত পাঠানোর জন্য ১০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা, জামিনের দরখাস্তের জন্য ১০০ থেকে এক হাজার টাকা, জামিননামা জমা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ১০০ থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। মামলার অন্যান্য ধাপেও নিয়মবহির্ভূত অর্থ লেনদেন হয়। তবে এই লেনদেন সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য নয় বলে জানিয়েছে টিআইবি।
গবেষণার জন্য টিআইবি ১৮টি জেলার অধস্তন আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী, আইনজীবীর সহকারী, জেলা আইনগত সহায়তা কর্মকর্তাসহ ৪৩৭ জনের কাছ থেকে তথ্য ও সাক্ষাৎকার নেয়। এর মধ্যে ৬৬ জন বিচারক রয়েছেন।
গবেষণার তথ্য তুলে ধরে টিআইবি বলেছে, অধস্তন আদালতের ওপর একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ অনেক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রশাসনিক সমন্বয়ের অভাবে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয় না। কিছু ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দেওয়ার পরও মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করেছে। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রেষণে কর্মরত বিচারিক কর্মকর্তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণে যাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করা হয়।
গবেষণার পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে বিচারকদের নিয়োগ, বদলি এবং পদোন্নতির বিষয়গুলো আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে, এ কারণে কিছু ক্ষেত্রে অধস্তন আদালত-ব্যবস্থার কার্যক্রম প্রভাবিত হয়, যা বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে ঝুঁকির সৃষ্টি করছে।
গবেষণার আওতাভুক্ত জেলাগুলোর ৬২১টি আদালতে ১১৪ জন বিচারকের সাময়িক ঘাটতি এবং ৫৭৯ জন সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ থেকে বিচারকদের কাছে বিচারিক কার্যক্রম বা অন্যান্য (জামিন দেওয়া, কর্মচারী নিয়োগ ইত্যাদি সম্পর্কিত) তদবির ও চাপ আসার অভিযোগ রয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদবির রক্ষা না করা হলে বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ারও অভিযোগ রয়েছে।
টিআইবি অধস্তন আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং শুদ্ধাচার চর্চা নিশ্চিত করতে ১৮ দফা সুপারিশ করেছে। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো অধস্তন আদালতের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত করা, যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও সংস্কার, অধস্তন আদালতগুলোর জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করা, পর্যাপ্ত জনবল, অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সুবিধা নিশ্চিত করা, বিচারপ্রার্থীদের জন্য বসার ব্যবস্থা, বিচারকদের নিয়োগপ্রক্রিয়া দ্রুততর করা, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের নিয়োগ স্বচ্ছ ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা প্রভৃতি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও অধস্তন আদালত বিচারব্যবস্থায় বাংলাদেশের মানুষের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, বিদ্যমান দ্বৈত প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা তৈরিসহ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। এ ব্যবস্থা অধস্তন আদালতগুলোর সার্বিক কার্য পরিবেশকে প্রভাবিত করছে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাম্মী লায়লা ইসলাম ও অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাজমুল হুদা মিনা।