স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে একসময় মির্জা শাহজাহান ধূমপান ছেড়ে দেন। নিয়মিত দৌড়াতে শুরু করেন। এতে সুফল পান। তখন থেকেই তিনি ধূমপান ছেড়ে নিয়মিত দৌড়াতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে আসছেন। বিশেষ কোনো সামাজিক বিষয় বা ঘটনা তৈরি হলে এর প্রতিবাদ জানিয়ে বা বিচার দাবিতে দৌড় শুরু করেন।
এখন তিনি মধুপুরে চলন্ত বাসে বহুজাতিক কোম্পানির কর্মী রূপা খাতুনকে ধর্ষণের পর হত্যার বিচার দাবিতে জনমত গঠনে দৌড় শুরু করেছেন। গত ২৫ আগস্ট রূপার এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় তোলে। মামলার পাঁচ আসামি এখন জেলে, তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়েছে। সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে আগামী ৩ জানুয়ারি।
রূপা হত্যার পর আদালত ভবনের সামনে থেকে দৌড় শুরু করেন শাহজাহান। অফিস-আদালত চত্বর এবং শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আদালত চত্বরে গিয়েই শেষ করেন।
মির্জা শাহজাহানের বাড়ি টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার একঢালা গ্রামে। বয়স ৬৫ বছর। এখন তিনি টাঙ্গাইল শহরের থানাপাড়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। পেশায় ছিলেন উন্নয়ন কর্মী। একাধিক বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) চাকরি করেছেন। দুই ছেলের জনক মির্জা শাহজাহান ১৫ বছর আগে ধূমপান ছেড়ে দেন এবং স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য নিয়মিত দৌড়াতে শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ধূমপানের বিরুদ্ধে প্রচার চালান।
এ পর্যন্ত তিনি টাঙ্গাইলের লৌহজং নদী দখলমুক্ত করার দাবিতে দৌড়েছেন নদীর তীরে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনায় শহরে দৌড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এখন তিনি দৌড়ের মাধ্যমে রূপাকে গণধর্ষণ ও হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে জনমত গঠন করছেন।
গত বুধবার টাঙ্গাইল আদালত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, হকারসহ নানা মানুষের উপস্থিতিতে সরব ওই চত্বর। আর এই মানুষের ভিড়ের ভেতর দিয়ে আদালতের চারপাশে দৌড়াচ্ছেন মির্জা শাহজাহান। যে কারও চোখ আটকে যায় দৌড়ানোর লোকটির দিকে। লোকটির পিঠে মধুপুরে রূপা খাতুনকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যাকারীদের বিচারের দাবিসংবলিত স্লোগান।
মির্জা শাহজাহান গণমাধ্যমকে জানান, মধুপুরে চলন্ত বাসে রূপাকে ধর্ষণ ও হত্যার খবর ফেসবুকে দেখে মর্মাহত হন। তখনই সিদ্ধান্ত নেন এই জঘন্য ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের দাবিতে আদালত এলাকায় দৌড়ে জনমত সৃষ্টি করবেন। সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি বুধবার তিনি এই কর্মসূচি পালন করছেন।
শুধু নিজে নিয়মিত দৌড়ে একা সুস্থ থাকতে চান না। দৌড়ের মাধ্যমে রোগমুক্ত থাকতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে মির্জা শাহজাহান প্রচার চালান। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি শহরের বিভিন্ন স্থানে ব্যানার টানিয়েছেন। মির্জা শাহজাহান বলেন, ‘আমার এই কর্মকাণ্ডকে পাগলামি মনে করতে পারেন। কিন্তু যে যাই মনে করুক, আমি দৌড়ে নিজে সুস্থ থাকছি। অপরদিকে বিভিন্ন ঘটনায় জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে পারছি। এটাই আমার তৃপ্তি।’
মির্জা শাহজাহানের স্ত্রীর নাম সামছুন্নাহার। তিনি এই কর্মকাণ্ডকে একসময় ভালোভাবে দেখতেন না। বিরক্ত হতেন এসব দেখে। কিন্তু যখন দেখছেন নিয়মিত দৌড়ের কারণে তাঁর স্বামী সুস্থ আছেন, তারপর থেকে আর বিরক্ত হন না। সামছুন্নাহার জানান, নিয়মিত দৌড়ানোর আগে তাঁর বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা ছিল। এখন আর তা নেই। তার এই দৌড়ানো দেখে অনেকে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী আতাউর রহমান আজাদ, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী জাফর আহমেদসহ কয়েকজন স্থানীয় নাগরিক জানান, মির্জা শাহজাহান প্রতি বুধবার আদালত এলাকায় দৌড়ের মাধ্যমে রূপা হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির কাজ করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
সুশাসনের জন্য প্রচার অভিযান (সুপ্র) টাঙ্গাইল শাখার সাধারণ সম্পাদক মঞ্জু রানী প্রামাণিক জানান, ‘মির্জা শাহজাহান তাঁর নিজের অবস্থান থেকে ধর্ষকদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করছেন। তাঁর মতো আমরাও নিজ অবস্থান থেকেও খুন, ধর্ষণ সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখতে পারি।’
-প্রথম আলো