এখন থেকে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতের পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করতে পারবে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আজ রোববার সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে দায়ের করা মামলায় হাইকোর্টের বিচারপতি জিনাত আরা ও বিচারপতি কাজী ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বেঞ্চ পর্যবেক্ষণসহ এ রায় দেন।
আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণের বিষয়ে আগেও আদালতে আসার সুযোগ ছিল। কিন্তু জনগণ এখন এ সম্পর্কে জেনেই আদালতে আসতে পারবে। এখন থেকে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে আহত কিংবা নিহতের পরিবারগুলো ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারবে।’
পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, “প্রায়ই অনিয়ন্ত্রিতভাবে গাড়ি চালানোর ফলে দেশে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। যেহেতু আমাদের দেশে ‘মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ, ১৯৮৩’ নামে একটি আইন রয়েছে। কিন্তু ওই আইন সম্পর্কে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো জানত না।”
আদালত বলেন,‘আইনটি সম্পর্কে (মোটর ভেহিক্যালস অধ্যাদেশ, ১৯৮৩) না জানার কারণে তারা (ক্ষতিগ্রস্তরা) কখনো আদালতে আসেনি। তবে এই রায়ের পর থেকে ভবিষ্যতে তাদের আদালতে আসার সুযোগ সৃষ্টি হলো। এখন থেকে কেউ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতির মুখোমুখি হলে আহত ব্যক্তি তার নিজের পক্ষে অথবা নিহত ব্যক্তির ক্ষেত্রে তার পরিবার এই আইনের অধীনে আদালতে আসতে পারবে।’
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর পরিবারকে চার কোটি ৬১ লাখ ৭৫ হাজার আটশত ৫২ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী তিন মাসের মধ্যে বাস মালিক, চালক ও সংশ্লিষ্ট ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে এই টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
তারেক মাসুদের মৃত্যুর ঘটনায় প্রায় ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে তাঁর স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি বিচারিক আদালতে করা হলেও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টে স্থানান্তর করা হয়।
গত ১৬ নভেম্বর এ মামলার উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের জন্য ২৯ নভেম্বর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।
ওই দিন আদালতে তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদের পক্ষে শুনানি করেন ড. কামাল হোসেন, চুয়াডাঙ্গা বাস মালিকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবদুস সুবহান তরফদার, রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিকী ও ব্যারিস্টার ইহসান এ সিদ্দিকী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ইসরাত জাহান।
২০১৬ সালের ১৩ মার্চ হাইকোর্টে ক্যাথরিন মাসুদের দায়ের করা ক্ষতিপূরণ মামলার শুনানি শুরু হয়। আদালতে ক্যাথরিন মাসুদের পক্ষে সাতজন, বাস মালিক সমিতির পক্ষে পাঁচজন ও রিলায়েন্স ইস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে একজন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
অন্যদিকে এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিশুক মুনীরের মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা ক্ষতিপূরণ মামলার শুনানি আগামী ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করেছেন আদালত।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জোকা এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মারা যান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং এটিএন নিউজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মিশুক মুনীর। তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটির সঙ্গে চুয়াডাঙ্গাগামী একটি বাসের সংঘর্ষ হয়। তাতে তারেক-মিশুকসহ মাইক্রোবাসের পাঁচ আরোহী নিহত হন।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে। ঘটনার দেড় বছর পর ২০১৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মানিকগঞ্জে মোটরযান অর্ডিন্যান্সে ১২৮ ধারায় বাস মালিক, চালক ও ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় বাসচালক জমির হোসেন, বাস মালিক কাসেদ মিয়া, মুজিবুল হক, মো. তুহিন ও রিলায়েন্স ইনস্যুরেন্স কোম্পানিকে বিবাদী করা হয়। তাঁদের সবাই জামিনে রয়েছেন।
মামলায় তারেক মাসুদের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ প্রথমে সাত কোটি ৭৬ লাখ ২৫ হাজার ৪৫২ টাকা আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। পরে ক্ষতিপূরণের দাবি বাড়িয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা করা হয়।
এরপর সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদ অনুসারে মামলা দুটি জনস্বার্থে হাইকোর্টে বদলির নির্দেশনা চেয়ে আবেদন করেন বাদীরা। মামলায় পাঁচজনকে বিবাদী করা হয়।
আদালত সংবিধানের ১১০ অনুচ্ছেদের আলোকে হাইকোর্টে বদলির জন্য বাদীদের করা আবেদন মঞ্জুর করেন ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর।