কুমার দেবুল দে :
বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য একসময় বর্গি শব্দটা ব্যবহার করা হত। তবে বর্তমানে ভয় দেখানোর জন্য “পুলিশ” শব্দটাই যথেষ্ট। পুলিশ দেখলে কি শুধু ছোটরা ভয় পায়? কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, সকল পেশা-শ্রেনীর মানুষই ভয় পায়। ভয়টা অবশ্য অহেতুক হয়রানীর। বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদ হলে পুলিশে ভয় সবচেয়ে বেশী, অবশ্য সাধারন মানুষও পুলিশকে এত ভয় পায় কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে। পুলিশকে নিয়ে গ্রামেগঞ্জে সাধারন মানুষের মাঝে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে, ‘আকাশে যত তারা পুলিশের তত ধারা’, আসলে কি তাই? তবে কি পুলিশকে আইন এত বেশী ক্ষমতা দিয়েছে? চলুন একটু দেখে নেই।
প্রথমে দেখে নেই সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২ যেখানে পুলিশকে মোটামুটি বিশ্বাসের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে এবং সাক্ষ্য আইনের ধারা ২৪-২৯ এর মূল বক্তব্য হল পুলিশের নিকট দেয়া জবানবন্দি এবং জবানবন্দি আদায়ের পদ্ধতি (তা যেভাবেই আদায় করা হোক না কেন) কোন আদালতে সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করা যাবেনা। যদিও মামলার তদন্তভার পুরোপুরি পুলিশের উপর ন্যস্ত এবং তার দেয়া তদন্ত রিপোর্ট দিয়েই কিন্তু আদালতে ফৌজদারি মামলার বিচার হয়।
সাধারণত গ্রেফতার করনে পুলিশের দুই শ্রেনীর ক্ষমতা আছে: ১. আদালত কতৃক আদীষ্ট হয়ে বা আদালত কতৃক ওয়ারেন্টপ্রাপ্ত হয়ে, ২. নিজস্ব গ্রেফতারের আইনগত ক্ষমতা বলে।
বাংলাদেশে যত আইন আছে এবং সে মতে যত অপরাধ আছে সব ক্ষেত্রেই আদালতের ক্ষমতা আছে অপরাধীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করার, কিন্তু সবক্ষেত্রে পুলিশ আসামীকে বা অপরাধীকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা রাখেনা। ফৌজদারি আইনের জগতে দুটি শব্দ আছে: ১. আমলযোগ্য অপরাধ বা কগনিজেবল অফেন্স, ২. অ আমলযোগ্য অপরাধ বা নন কগনিজেবল অফেন্স। এই দুই অপরাধের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ধারা- ৪ এর (এফ) এবং ( এন) আমলযোগ্য অপরাধ বলতে সে সব অপরাধকে, যা করলে পুলিশ বিনা ওয়ারেন্টে আসামীকে গ্রেফতার করতে পারে, আর অ আমলযোগ্য অপরাধ বলতে বুঝানো হয়ছে সেই সমস্ত অপরাধকে, যা করলে আসামীকে পুলিশ আদালতের আদেশ ব্যতীত গ্রেফতার করতে পারে না।
অপরাধ বলতে বুঝানো হয়েছে সেই সকল কাজ বা কার্য বিরতিকে যাহা কোন আইনে অপরাধ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ( ধারা-৪(ও))। দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর অধীনেকৃত অপরাধে জডিত অপরাধীর ক্ষেত্রে, আদালত তাকে গ্রেফতারী পরোয়ানা ইস্যু করতে চাইলে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ২য় তফসীলের ৪র্থ কলামের বিধি অনুসরণ করবেন আর অন্যকোন বিশেষ আইনে কৃত অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনের বিধান অনুসরণ করবেন। দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর অধীনেকৃত অপরাধীকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশ ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ এর ২ য় তফসীলের ৩য় কলাম অনুসরণ করবে।
এবার আসি গ্রেফতার বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির বিধান সমূহে, এই বিষয়ে ধারা (৫৪- ৫৯)
“৫৪ ধারা ” শব্দটা বাঙ্গালীর বড়ই পরিচিত একটা শব্দ, অনেক সময় দেখা যায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করলে ক্ষমতাসীন সরকার বিরোধী দল গুলোকে দমানোর জন্য পুলিশকে এই ধারার অধীনে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করার জন্য উদ্ভুদ্ধ করে। শুধু তাই নয়, শান্তির সময়েও পুলিশ সাধারণ বা অসাধারণ সকল ধরনের মানুষকে গ্রেফতার বা হয়রানি করতে এই ধারার বিশেষ ব্যবহার করে থাকে।
আশ্চর্য হলেও সত্যি এই যে গ্রেফতার বিষয়ে ৫৪ ধারা একটা কমপ্লীট আইন, পুলিশের গ্রেফতার করার যত ক্ষমতা সব এই একটা ধারাতেই। ৫৪ ধারার ক্ষমতা ব্যতীত পুলিশ কোন ব্যক্তিকে কখনো গ্রেফতার করতে পারেনা, এই বিষয়ে আইনজীবী, আদালত ও সাধারণ মানুষ সবার মধ্যেই একটা ভুল ধারণা আছে। একটা বিষ বিহীন সাপ যেমন কামড়াতে পারবে, ভয় দেখাতে পারবে কিন্তু মেরে ফেলতে পারবে না তেমনি ৫৪ ধারার ক্ষমতা ব্যতীত পুলিশও সব করতে পারবে কিন্তু আসামী গ্রেফতার করতে পারবে না। আমরা সাধারণত ৫৪ ধারায় গ্রেফতার মানে সন্দেহজনক গ্রেফতার বুঝি? এই সন্দেহজনক গ্রেফতার কি? আমলযোগ্য অপরাধ সংগঠন করার সন্দেহজনক সম্ভাবনা। এইটা আসলে শুধুমাত্র একটা শ্রেনী বাকি রয়েছে আরও ৮ টা শ্রেনী। এবং এই একটা শ্রেনীর ক্ষমতাই পুলিশকে গ্রেফতার করার ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছে বলে আমাদের ধারণা।
৯টি বিশেষ শ্রেণীর অপরাধীদের গ্রেফতার করতে পারে পুলিশ ৫৪ ধারার অধীনে, এই ৯ শ্রেনীর অপরাধীকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে পুলিশের আদালতের আদেশ লাগেনা, অবশ্য এই ৯ শ্রেনীর বাইরে খুব কমই অপরাধী আছে। এবার দেখা যাক এগুলো কি কি :
১. আমলযোগ্য অপরাধ যদি কেউ করে থাকে অথবা তাতে জড়িত থাকার সম্ভাবনা/ সন্দেহ করার যুক্তিযুক্ত কারন। এইটা একটা ব্যাপক ক্ষমতা এর কারনে পুলিশ এত ক্ষমতাশালী এবং পুলিশের চাকরি এত লোভনীয়।
২. কারও কাছে ঘর ভাংগার সরঞ্জামাদি থাকলে।
৩. সরকার কাউকে অপরাধী বলে ঘোষনা করলে।
৪. কারও কাছে চোরাইমাল পাওয়া গেলে।
৫. পুলিশ কে তার কাজে বাধাদান বা আইনগত হেফাজত থেকে পলায়নকারী ব্যাক্তি।
৬. সশস্ত্রবাহিনী হতে পলায়নকারী ব্যাক্তি।
৭. দেশের বাইরে কৃত অপরাধে অভিযুক্ত ব্যাক্তি, যদি অপরাধটি বাংলাদেশে করলে অপরাধ হয়ে থাকে।
৮. সাজাভোগ করে মুক্তিপ্রাপ্ত আসামী যদি একই অপরাধ আবার করে।
৯. অন্যকোন থানা হতে আসামী গ্রেফতারের অনুরোধ পাওয়া গেলে।
এর বাইরে ধারা- ৫৫ মতে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় ভবঘুরে, অভ্যাসগত চোর, ডাকাত, ছিনতাইকারী, গৃহ ভঙ্গকারীদের গ্রেফতার করতে পারে।
ধারা- ৫৬ তে শুধু ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকেই বিনা পরোয়ানায় আসামীকে গ্রেফতারের ক্ষমতা” দেয়া হয়েছে, তিনি যদি অন্যকোন পুলিশকে এই ক্ষমতা অর্পন করতে চান তবে লিখিত আদেশ দিয়ে এই ক্ষমতা অর্পন করতে হবে, এবং এইক্ষেত্রে আসামী দেখতে চাইলে সেই লিখিত আদেশ খানা তাকে দেখাতে পুলিশ বাধ্য থাকবে।
ধারা- ৫৭ তে অ আমলযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত ব্যাক্তিকেও গ্রেফতার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে যদি সে শুদ্ব নাম ঠিকানা পুলিশকে না জানায়, তবে শুদ্ব তথ্য দেয়ার সাথে সাথে তাকে ছেড়ে দিতে হবে।
ধারা- ৫৯ এ বলা হয়েছে সাধারন ব্যাক্তিও চাইলে আসামীকে গ্রেফতার করতে পারে, খুশী হবার কোন কারন বাস্তবে পুলিশ না আসা পযন্ত আসামীকে আটক রাখার ক্ষমতা দিয়েছে গ্রেফতারের নয়।
এবার জেনে নেওয়া যাক সকল পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে কিনা? উত্তর হচ্ছে, না। আমি এ লেখায় যতবারই পুলিশ শব্দটা ব্যবহার করেছি আইন সে জায়গাগুলোতে বারবার পুলিশ অফিসার শব্দটা ব্যবহার করেছে। পুলিশ অফিসার শব্দটির ব্যাখ্যা পুলিশ রেগুলেশন্স অব বেঙ্গল, ১৯৪৩ বা সংক্ষেপে পিআরবি’র কোথাও নেই। কিন্তু পুলিশ অফিসার বলতে কাদের বুঝায় তার একটা আভাষ পাওয়া যায় ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা- ৪(পি) এ, মতে কনস্টেবল ছাড়া তার উপরের পদবীধারী বাকি সকল পুলিশকে অফিসার হিসাবে গণ্য করা হয়।
আসলে ৫৪ ধারাই সব, গ্রেফতার বিষয়ে পুর্ণাঙ্গ আইন। পুলিশকে দন্ডবিধির অপরাধে কাউকে গ্রেফতার করতে হলে ৫৪ ধারা মতেই করতে হয়। আর বিশেষ আইনসমূহ অনুসারে গ্রেফতার করতে হলে ৫৪ ধারা ছাড়া আর কোন উপায়ই নাই। কারণ এই সমস্ত আইনসমূহে গ্রেফতার সম্পর্কিত বিধানে একটাই কথা লিখা থাকে আর তা হল “এই আইনের অধীনে অপরাধগুলো হবে আমলযোগ্য” আর আমলযোগ্য অপরাধে গ্রেফতার করতে হলে অবশ্যই ৫৪ ধারা মতেই করতে হবে।
লেখক : সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরী কমিটির সদস্য