কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার দাবি করেছেন, আদালতে দেওয়া জবানবন্দি তার নিজের নয়। তিনি বলেন, ‘আমি নাটক করিনি, আমাকে যা বলা হয়েছে, তাই করেছি। আদালতে দেওয়া জবানবন্দি আমার নয়। আমাকে যা লিখে দেওয়া হয়েছে, আমি তাই আদালতে দিয়েছি।’
শনিবার সন্ধ্যায় শ্যামলীতে নিজ বাসভবনে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
গত ৭ ডিসেম্বর অপরাধবিষয়ক মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন ও মিথ্যা মামলা করে বিভ্রান্ত ও হয়রানি করার অভিযোগ আনায় ফরহাদ মজহার ও তার স্ত্রী মানবাধিকার কর্মী ফরিদা আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করার আদেশ দেন আদালত।
এর পর শনিবার হঠাৎ ডাকা এই সংবাদ সম্মেলনে ফরহাদ মজহার বলেন, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় তাকে আদাবর থানায় নিয়ে আসা হয়। প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাকে পরিবারের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। অনেকক্ষণ থানায় বসিয়ে রেখে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। ডিবি অফিসে বিধ্বস্ত অবস্থায় তাকে জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার জন্য একটি লিখিত কপি দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়। তিনি আরও বলেন, ‘আমি প্রচণ্ড বিভ্রান্ত অবস্থায় আদালতকে বলতে পারি যে, আমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। আমার ভীতি ও ট্রমা এখনও কাটেনি। ডিবি অফিস আমাকে দিয়ে যা লিখে নিয়েছে, আমি তাই আপনাকে দিচ্ছি। এরপর তার (আদালত) অনুমতি নিয়ে তার (বিচারক) কক্ষের একটি সোফায় আমি এলিয়ে পড়ি।’
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ফরহাদ মজহার বলেন,’আজই শেষ নয়, আরও কথা হবে। আমি শুধু আমার একার জন্য বসিনি। দেশে যারা গুম হয়েছে, তাদের জন্যও আপনাদের সঙ্গে বসেছি।’
বিচারাধীন বিষয়ে প্রশ্ন না করার অনুরোধ জানিয়ে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমাকে প্রশ্ন করবেন না। আমি চাই, বিচার স্বাধীন গতিতে চলুক। আমাকে গুম করা হয়েছিল। আমি একজন ভিকটিম। অথচ আমাকে মামলার আসামি করা হয়েছে।’
আপনি মামলা থেকে বাঁচতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন কি-না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার নিজের জন্য নয়। দেশে যারা গুম হয়েছে, তাদের জন্য। আমি ফিরে এসেছি। তারা এখনও ফেরেনি।’
অপহরণের ঘটনা তুলে ধরে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘গত ৩ জুলাই ভোরে আমি কম্পিউটারে লিখতে গিয়ে দেখি, চোখ খুলতে পারছি না, শুকনা। লেখা কিছুই পড়তে পারছি না। এ অবস্থা হলে ওষুধ কেনার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা ফার্মেসিতে যাই। ওই সময় তিনজন লোক আমাকে ঘিরে একটি সাদা মাইক্রোবাসে জোর করে তুলে আমার চোখ বেঁধে ফেলে। এ সময় মোবাইল ফোন আমার হাতেই ছিল, আমি আমার স্ত্রী ফরিদা আক্তারকে ডায়াল করা অবস্থায় ছিল। ভাগ্যক্রমে তাকে আমি প্রথম ফোন করতে পেরেছি। এরপর বাঁচার জন্য টেলিফোন করা, টাকা পাঠানোসহ অপহরণকারীরা যা কিছু করতে বলে, আমি তাই করি। যেখানে আমাকে ছেড়ে দেয়, আমি চিনি না। আমি বুঝতে পারি, তারা আমার ওপর নজরদারি রেখেছে। তাদের নির্দেশমতো সন্ধ্যায় হানিফ পরিবহনের গাড়িতে উঠলে গাড়িতে তারা আমাকে বাসের পেছনে বসিয়ে দেয়। আমি নিশ্চুপ হয়ে ভীত, বিধ্বস্ত ও শারীরিক অসুস্থতায় নিস্তেজ হয়ে পড়ি। শোরগোল শুনে আমি জেগে উঠি। কিছু সাদা পোশাকের লোক জোর করে আমাকে নামিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। আমাকে আবার মারার জন্য নামিয়ে নিচ্ছে ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। সাদা পোশাকের কিছু ব্যক্তি র্যাবের দিকে বন্দুক তুলে আমাকে শাসিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড তর্ক হয়। কিন্তু র্যাব রীতিমতো ছোটখাটো যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে আমাকে তাদের গাড়িতে ওঠায়। আমার স্ত্রী ফরিদা আক্তারের সঙ্গে কথা বলে আমাকে আশ্বস্ত করে। কিন্তু সাদা পোশাকের লোকগুলো জোর করে আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে।’
র্যাবের সামনে বন্দুক উঁচু করে যারা আপনাকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, তারা কি র্যাবের চেয়ে শক্তিশালী? তাদের আপনি চিনতে পেরেছেন কি-না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাব তিনি এড়িয়ে যান।
এর আগে গত ৩১ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মাহাবুবুল ইসলাম আদালতে ফরহাদ মজহারকে অপহরণ করে চাঁদা দাবি করার অভিযোগ তদন্তে সত্য প্রমাণিত হয়নি মর্মে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। একই সঙ্গে মিথ্যা অপহরণের মামলা করে বিভ্রান্ত ও হয়রানি করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় ফরহাদ মজহার ও ১০৯ ধারায় তার স্ত্রী ফরিদা আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের অনুমতি চান তদন্ত কর্মকর্তা।
আবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তদন্তকালে বিভিন্নজনের জবানবন্দিসহ অন্যান্য সাক্ষ্য-প্রমাণ বলছে, অপহরণ বিষয়ে ফরহাদ মজহার সত্য তথ্য দেননি। তার স্ত্রী ফরিদা আক্তার অপহরণের মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। তার স্ত্রী মিথ্যা অভিযোগ করলেও পরবর্তী সময়ে তা প্রত্যাহার করেননি।
গত ৩ জুলাই ভোররাতে মোহাম্মদপুর লিঙ্ক রোডের হক গার্ডেনের নিজ বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন ফরহাদ মজহার।