প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য রাখার অতীত দৈর্ঘ্যের রেকর্ড এবার ভাঙল। স্বাধীনতার গত ৪৬ বছরে তৃতীয়বারের মতো প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বিলম্ব ঘটছে। সে কারণে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগেও অনিশ্চয়তা চলছে। অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির নিজেরই শপথ নেই। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তিনি কীভাবে নতুন বিচারকদের শপথ দেবেন?
এই অনিশ্চয়তা সম্পর্কে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গণমাধ্যমকে বলেন, এ কারণে তো কোনো কিছু বন্ধ হয়ে নেই। কিন্তু আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের বিচারকে যে স্বল্পতা চলছে? এ প্রশ্নের উত্তরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রাষ্ট্র জনগণের। তাই টেকনিক্যাল প্রশ্ন বড় হতে পারে না। প্রয়োজনে তিনি শপথ পাঠ করাতে পারবেন।’
ইতিমধ্যে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার দিয়ে জারি করা প্রজ্ঞাপনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। সর্বশেষ প্রজ্ঞাপনে ২০ নভেম্বর কিংবা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার স্বীয় কার্যভার নেওয়া অবধি তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এরপর আর কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়নি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সাংবিধানিক পদে আসীন ব্যক্তিরা দীর্ঘ ছুটিতে থাকলে প্রজ্ঞাপন জারির রীতি আছে। মহা হিসাব নিরীক্ষক এ কে আজিজুল হক ১৯৮৬ সালে এক মাসের ছুটিতে গেলে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১৩০ অনুচ্ছেদের আওতায় জ্যেষ্ঠতম নিরীক্ষক শামসুদ্দিন আহমেদ ভুঁইয়াকে অস্থায়ী মহা হিসাব নিরীক্ষক নিয়োগ দেন। রাষ্ট্রপতির আদেশে ১৯৮৬ সালের ৮ ডিসেম্বর অর্থ বিভাগের সচিব এম মুস্তাফিজুর রহমানের স্বাক্ষরে বিজ্ঞপ্তিটি জারি করা হয়েছিল। গতকাল মহা হিসাব নিরীক্ষক কার্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, তাঁকে মাসে তিন শ টাকা দায়িত্ব ভাতা দেওয়া হয়েছিল। কর্মকর্তারা দাবি করেন, শুরুতে এক মাসের জন্য দায়িত্ব দেওয়া হলেও তিনি প্রায় এক বছর দায়িত্বরত ছিলেন। এমনকি প্রধান বিচারপতি তাঁকে শপথও পড়িয়েছিলেন। সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু গণমাধ্যম বলেন, এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন হওয়া উচিত। তবে অচিরেই স্থায়ী নিয়োগ হবে বলেই হয়তো প্রজ্ঞাপন জারি হচ্ছে না।
দেশের অনেক আইনবিদ মনে করেন, বিশ্বের কোনো দেশেই অনির্ধারিত সময়ের জন্য প্রধান বিচারপতির পদ খালি রাখা হয় না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মাত্র একবার প্রধান বিচারপতি নিয়োগে বিলম্ব ঘটেছিল। তখন রিসেস বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়। ভারতে এক দিনের জন্যও প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য থাকেনি। বাংলাদেশের বিধান ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে আলাদা। পাকিস্তানে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকেও দায়িত্ব পালন করার জন্য শপথ নিতে হয়, যদিও ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিরা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। গত বছর ভারতের রাজ্যসভায় পেশ করা ৮৭তম রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘কর্মরত প্রধান বিচারপতির সম্মতিতেই শুধু ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিয়োগের প্রশ্ন আসবে। এক মাসের বেশি সময় কোনো ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিও রাখা যাবে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১৬তম সংশোধনী মামলার একজন অ্যামিকাস কিউরি গণমাধ্যমকে বলেছেন, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করা মাত্রই তাঁর পদ শূন্য হয়ে গেছে। সাক্ষ্য আইন তা-ই বলে। আর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বা স্পিকার দিয়ে অনির্দিষ্টকাল চলা সংবিধানসিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু প্রধান বিচারপতির ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। কারণ, সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ প্রধান বিচারপতিকে সুনির্দিষ্ট একজন ব্যক্তি হিসেবে সাব্যস্ত করেছে, যা দেশের রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারকে করা হয়নি। সংবিধানে বলা হয়েছে, ‘“রাষ্ট্রপতি” অর্থ এই সংবিধানের অধীনে নির্বাচিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি কিংবা সাময়িকভাবে উক্ত পদে কর্মরত কোনো ব্যক্তি। “স্পিকার” অর্থ ৭৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে সাময়িকভাবে স্পিকারের পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি।’ সংবিধানের ৫৪ অনুচ্ছেদ বলেছে, রাষ্ট্রপতি অসুস্থ বা তাঁর পদ শূন্য হলে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। আবার ৭৪(৩) অনুচ্ছেদ বলেছে, স্পিকার রাষ্ট্রপতি হিসেবে কর্ম পালন করলে ডেপুটি স্পিকার স্পিকার হবেন। সংবিধানের আওতায় রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি ও স্পিকার-এই তিন সাংবিধানিক পদধারী শপথ পাঠ করাতে পারেন। অন্যদের ক্ষেত্রে বিকল্প রাখা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানে ‘প্রধান বিচারপতি’ অর্থ ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’।
বর্তমান দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি কোন নিয়মে বেতন-ভাতা পাবেন, জানতে চাইলে সাবেক মহা হিসাব নিরীক্ষক এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, এখানে জোরালো নৈতিকতার প্রশ্ন আছে। দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতিকে দিয়ে দীর্ঘ সময় কাজ করানো হলে তিনি কেন একজন আপিল বিভাগের বিচারকের সমান বেতন-ভাতা পাবেন?
১৯৭৮ সালের আইন অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগের বিচারকদের চেয়ে বেশি বেতন পান। তাঁর মাসিক বেতন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। আপিল বিভাগের বিচারকদের থেকে এর পরিমাণ ৫ হাজার টাকা বেশি। এ ছাড়া ডোমেস্টিক এইড ও সাম্পচুয়ারি ভাতা হিসেবে অন্য বিচারপতিদের চেয়ে প্রধান বিচারপতি আরও ৯ হাজার টাকা বেশি পান। হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য রেখে তাঁকে (দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি) তাঁর প্রাপ্য দায়িত্ব ভাতা থেকে বঞ্চিত করাটা হবে অভাবনীয়। তিনি তো প্রধান বিচারপতির দপ্তর এবং বাসভবনও ব্যবহার করতে পারবেন না।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এর আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ প্রধান বিচারপতির ‘অনুরূপ কার্য’ পালনের এখতিয়ার দিয়েছে, তাই শপথ পড়ানোর পক্ষে তাঁর কোনো বাধা নেই। এ প্রসঙ্গে ওই অ্যামিকাস কিউরি বলেন, সংবিধানকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা সমীচীন নয়, যাতে বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। প্রধান বিচারপতি ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট অসম্পূর্ণ। সংবিধানের আওতায় প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি পদে সব অবস্থায় যথাযথভাবে নিয়োগ পাওয়া ব্যক্তিকেই থাকতে হবে।’
সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ বলেছে, প্রধানমন্ত্রীকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রপতি এককভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। ৯৪ অনুচ্ছেদের ২ দফা বলেছে, তাঁর পরিচয় হবে ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ এবং তিনিসহ অন্য বিচারকদের নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হবে। ৩ দফা বলেছে, প্রধান বিচারপতি আপিল বিভাগে বসবেন। ৪ উপদফা বলেছে, প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব পালনে স্বাধীন থাকবেন। এরপর ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ দফা বলেছে, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করেই অন্যান্য বিচারক নিয়োগ করা হবে।
সংবিধানে প্রধান বিচারপতির অবস্থান ব্যাখ্যা করে সদ্য অবসরে আসা হাইকোর্টের বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, ‘প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য রাখা সংবিধানের চেতনাবিরোধী। অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি যদি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন, তখন কী হবে?’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইনবিদ অভিন্ন অভিমত জানিয়ে বলেন যে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টসহ চারটি সাংবিধানিক সংস্থা গঠনে সরাসরি ভূমিকা রাখেন। তাঁকে শুধু সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদেরই নয়, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্যদের শপথ পড়াতে হয়। ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধানের অধীনে রাষ্ট্রপতি যেকোনো কনিষ্ঠ বিচারককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি করতে পারেন। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো কারণে বর্তমানে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি ছুটি নিলে বা অসুস্থ হলে সংবিধান অকার্যকর হওয়ার ঝুঁকি দেখা দেবে।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর ১০ মাসের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনকালে কাউকে শপথ পড়াননি। বাহাত্তরের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে শপথ পড়াতেন প্রধান বিচারপতি। ২০১১ সালে প্রধান বিচারপতির বদলে স্পিকারের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধান অনুসারে প্রধান বিচারপতিকে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের শপথও পড়াতে হতো। চতুর্থ সংশোধনীতে তা বাতিল করে এ দায়িত্ব দেওয়া হয় রাষ্ট্রপতিকে। ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর পর থেকে তা টিকে আছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে সংবিধান তৈরির সময় অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের খসড়ায় বলা হয়েছিল, ‘রাষ্ট্রপতির নিকট মনে হইলে’ তিনি অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের হাতের লেখা সংবিধানে দেখা যায়, তিনি ২ অক্টোবর ১৯৭২, সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির নিকট ‘সন্তোষজনকভাবে মনে হইলে’ কথাটি যুক্ত করেন। আইনবিদেরা মনে করেন, এতে রাষ্ট্রপতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। এই সন্তুষ্টি মানে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি নয়।
গত সপ্তাহে বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে দায়িত্বরত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে মামলা ও বিচারকের অনুপাতের সংকট এবং সব স্তরে আশু বিচারক নিয়োগের প্রসঙ্গ টেনেছেন। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রাষ্ট্রীয় জীবনে এসব বড় বিষয় নয়। বিচার বিভাগের কর্মক্ষমতা ও সুনাম বাড়াতে হবে। আস্থার ঘাটতি দূর করতে হবে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৯৮৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী অবসরে গেলে কর্মে প্রবীণতম বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে প্রধান বিচারপতি করা নিয়ে জটিলতা দেখা দেয়। ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির এক জরুরি সাধারণ সভায় আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতমকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বর্তমানে প্রধান বিচারপতির কার্যভাররত বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা সমিতির তৎকালীন সম্পাদক হিসেবে সভাটি পরিচালনা করেন। তাঁর সই করা নথিতে লেখা আছে, প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হওয়ার পরে কালক্ষেপণ করা যাবে না। অনতিবিলম্বে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে। আপিল বিভাগের কাজে প্রবীণতম বিচারককেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা ‘সাংবিধানিক রেওয়াজ ও ঐতিহ্য’।
ওই সিদ্ধান্তে সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারককে জ্যেষ্ঠতার নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে আহ্বান জানানো হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি এরশাদ ও আইনমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা উপরাষ্ট্রপতি মওদুদসহ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের প্রত্যেক বিচারপতিকে ওই সিদ্ধান্তের অনুলিপি দেওয়া হয়। গণমাধ্যমের কাছেও তা বিতরণ করা হয়। উল্লেখ্য, ১৯৫৪ সালে জওহরলাল নেহরু জ্যেষ্ঠতম বিচারকের বদলে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারক বিজন কুমার মুখার্জিকে প্রধান বিচারপতি হতে অনুরোধ করেন। তিনি তা নাকচ করে বলেছিলেন, জ্যেষ্ঠতমকে ডিঙিয়ে বিচারালয়ের সর্বোচ্চ পদে আসীন হলে নিজেকে তাঁর জবরদখলকারী মনে হবে। পরে নেহরু মেহের চান্দ মহাজনকে প্রধান বিচারপতি করেন। তিনি অবসরে গেলে বিজন কুমার ভারতের চতুর্থ প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। ভারতের গত ৭০ বছরের ইতিহাসে ৪৫ জন প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিতে গিয়ে রাষ্ট্রপতিরা কখনো এক দিনের জন্যও প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হতে দেননি।
বাংলাদেশের বিচারকদের ওপর ওই সিদ্ধান্তের আইনি কার্যকরতা না থাকলেও তার নৈতিক নির্দেশনা আছে বলে মন্তব্য করেছেন ১৯৯০ সালে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভায় অংশগ্রহণকারী ও বারের সাবেক সম্পাদক প্রবীণ আইনজীবী এ ওয়াই মসিউজ্জামান। তিনি বলেন, পরবর্তী সময়ে জ্যেষ্ঠতার ব্যত্যয় ঘটে থাকলেও সুপ্রিম কোর্ট বারের ওই সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত অপরিবর্তিত এবং সুপ্রিম কোর্ট বারের সব সদস্যের তা মেনে চলার বাধ্যতাবাধকতা আছে। তিনি আরও বলেন, ‘অষ্টম সংশোধনী বাতিল মামলার রায়ে ক্ষুব্ধ এরশাদ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে ডিঙাতে পারেন বলে আমাদের আশঙ্কা ছিল। এ ঘটনার কিছুদিন আগেই প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনকে অপসারণ করা হয়েছিল। সে প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতি হিসেবে মুনিমকে আনলে আমরা তাঁকে বয়কট করি। তিন বছর তাঁকে এজলাসে বসতেই দিইনি। তাই আমরা আহ্বান জানাই, সুপ্রিম কোর্টের অন্য কনিষ্ঠ বিচারকেরা যাতে প্রধান বিচারপতির পদ না নেন।’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম অবশ্য গণমাধ্যমকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট বার কোনো সংবিধিবদ্ধ সংস্থা নয়। জ্যেষ্ঠতা সাংবিধানিক রেওয়াজ কি না তার উত্তরে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার। বিচারকেরা কেউ কারও চেয়ে কম নন। সবার সমান ক্ষমতা। প্রধান বিচারপতি শুধু অন্যদের চেয়ে এককভাবে বেঞ্চ গঠন করতে পারেন। আর সেই রাষ্ট্রপতির (এরশাদ) সঙ্গে বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে তুলনা করা ঠিক হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান বিচারপতি মারা গেলে বাইরে থেকেও নতুন নিয়োগ হয়ে থাকে।’
১৯৯০ সালে বার সভার দিনটি ছিল মঙ্গলবার। সমিতির সহসভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহর সভাপতিত্বে বেলা সোয়া একটায় দক্ষিণ হলে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে শামসুল হক চৌধুরী, খোন্দকার মাহবুব উদ্দিন আহমদ (পরে বিএনপির সাংসদ), শওকত আলী খান, আমিনুল হক (পরে অ্যাটর্নি জেনারেল), এ এন এম গাজীউল হক (ভাষাসৈনিক) এবং সুধাংশু শেখর হালদার (পরে আওয়ামী লীগের সাংসদ) মারা গেছেন। আমীর-উল ইসলাম, আবদুল বাসেত মজুমদার (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক), কে এস নবী (পরে আওয়ামী লীগের অ্যাটর্নি জেনারেল) জ্যেষ্ঠতার নীতি মেনে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ সমর্থন করে সে সভায় বক্তৃতা করেন। আবদুল বাসেত মজুমদার গত রাতে গণমাধ্যমকে বলেন, ১৯৯০ সালের ওই সিদ্ধান্ত তাঁর মনে আছে।
বারের বর্তমান সিদ্ধান্ত কী তা জানতে চাইলে বার সভাপতি জয়নুল আবেদীন গণমাধ্যমকে বলেন, প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য থাকা বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। আজ সভা ডাকা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সেখানে কথা হবে। আইন ও বিচারমন্ত্রী আনিসুল হক এর আগে বলেছিলেন, প্রয়োজনে আগামী এক বছরেও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ না-ও হতে পারে।
মিজানুর রহমান খান/প্রথম আলো