চৌধুরী তানবীর আহমেদ ছিদ্দিক
বিবাহের সংজ্ঞা আসলে দেওয়া মত কিছু না, সামাজিকভাবে আমরা সকলেই এর সাথে পরিচিত। তারপরও বিভিন্ন ধর্ম কিংবা বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়াদি থেকে যে সংজ্ঞা পাই তা সংক্ষেপে বললে অনেকটা এমন যে, “বিবাহ হল একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়”। বিভিন্ন দেশে সংস্কৃতিভেদে বিবাহের সংজ্ঞার তারতম্য থাকলেও সাধারণ ভাবে বিবাহ এমন একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও যৌন সম্পর্ক সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে। বিবাহের মাধ্যমে বংশবিস্তার ও উত্তরাধিকারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিবাহের মাধ্যমে পরস্পর সম্পর্কিত পুরুষকে স্বামী এবং নারীকে স্ত্রী হিসাবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের জীবনকে “দাম্পত্য জীবন” হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।
পৃথিবীতে অনেক ধর্ম থাকলেও কেবল মাত্র মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ এবং জৈন ধর্মগুলো সম্বন্ধেই আমরা বিশেষ ভাবে অবগত। এর মধ্যে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধই সবচেয়ে বেশী পরিচিত। বিবাহ যেহেতু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সেহেতু সকল ধর্মেই বিবাহ নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছে। তবে, এই আলোচনার মধ্যে একটা সীমাবদ্ধ রয়েছে আর সেটি হচ্ছে বিবাহের দুই পক্ষ অর্থাৎ পুরুষ এবং নারী দুইজনকে অবশ্যই একই ধর্মের হতে হবে। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান,বৌদ্ধ প্রায় সব ধর্মেই একই রীতি যে, বিয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই নিজ ধর্মের অনুসারে কাউকে বিয়ে করতে হবে। তবে, ইসলাম ধর্মে পুরুষদের জন্য এর পরিধিটা কিছুটা বৃদ্ধি করা আছে। মুসলিম পুরুষরা চাইলে, অমুসলিম কিন্তু কিতাবিয়া(খ্রিষ্টান এবং ইহুদিরা কিতাবিয়া) নারীকে বিয়ে করতে পারবে, তবে মুসলিম নারী কোন অমুসলিম কিতাবিয়া পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে না। এছাড়া, বাকী সকল ধর্মের ক্ষেত্রে তারা কেবল নিজ নিজ ধর্মের লোককেই বিয়ে করতে পারবে।
কিন্তু মানুষ সুন্দরের পূজারী। তাই প্রেম, ভালোবাসা কিংবা বিবাহ করার ক্ষেত্রে শুধু যে, নিজ ধর্মের লোককেই পছন্দ হবে, তা কি স্থায়ীভাবে বলা যায়? আর বিয়ে যেহেতু পুরো জীবনেই একবার সেহেতু নিজের পছন্দকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হয়। আর, সেই গুরুত্ব দিতে গিয়ে মনোভাব, অঞ্চল, প্রকৃতি, রূপ-লাবণ্যে ভিত্তিতে অন্য ধর্মের কাউকে ভালো লেগে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে, অস্বাভাবিক যেই ব্যাপার সেটা হচ্ছে বিবাহ। ভিন্ন ধর্মের কাউকে তো বিবাহের রীতি কোন ধর্মে নেই, তাহলে কীভাবে বিবাহ সম্পন্ন হবে এই প্রশ্নে যখন কেউ উত্তর খুঁজে পায় না, তখন কাউকে ধর্মান্তরিত হতে হয়, কাউকে বা ভালোবাসা বিসর্জন আবার অনেকেই জীবন বিসর্জন। তবে, সবকিছু রোধে আইনে যে সমাধান রয়েছে তা অনেকেরই অজানা।
ব্রিটিশ শাসনামলেই ব্রিটিশরা এই আইনটি তৈরি করে গেছে। যে কোন ধর্মের লোকই “বিশেষ বিবাহ আইন,১৮৭২” অনুযায়ী তার ভিন্ন যে কোন ধর্মের লোককে বিশেষ বিবাহ করতে পারবে। যে ব্যক্তি মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন এর কোন একটির অনুসারী কিন্তু সে নিজ ধর্ম ভিন্ন অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে চায়, সে বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ এর অধীনে বিবাহ করতে পারবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে সকল বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহ রয়েছে, এই আইনের মাধ্যমে সেসব বিয়ের বৈধতাও নিশ্চিত করা যায়। মূলকথা হচ্ছে, এই আইনের অধীন বিবাহ করতে গেলে ধর্মহীন হয়ে, তারপর বিবাহ অনুষ্ঠান করতে হবে। যার কারনে, যার কোন ধর্ম নাই, সেও এই আইনের অধীন বিবাহ করতে পারবে।
বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ এর ২ ধারা অনুযায়ী বিয়ে অনুষ্ঠানের বেশ কিছু শর্ত রয়েছে।
(১) বিয়ের সময় বিয়ের পক্ষগণের মধ্যে কারোই কোনো জীবিত স্বামী বা স্ত্রী থাকতে পারবে না, অর্থাৎ, স্বামী বা স্ত্রী থাকা অবস্থায় কেউই বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিশেষ বিবাহ করতে পারবে না।
(২) বিবাহ ইচ্ছুক পুরুষ ব্যক্তির বয়স গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ১৮ বছর এবং মহিলার বয়স ১৪ বছর পূর্ণ হতে হবে,
(৩) পক্ষগণ রক্ত সম্পর্কে বা বৈবাহিক সম্পর্কে সম্পর্কযুক্ত হতে পারবেন না, যাতে তাদের একজনের ওপর প্রযোজ্য আইন দ্বারা ওই বিবাহ অবৈধ হতে পারে।
বিশেষ বিবাহের ক্ষেত্রে নোটিশ অত্যন্ত জরুরী। বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ এর ৪ ধারায় বলা আছে, বিয়ের দুই পক্ষের মধ্যে যে কোনো একটি পক্ষ রেজিস্ট্রারের কাছে ১৪ দিন আগে বিয়ের নোটিশ পাঠাবে। যদি না এই সময়ের মধ্যে কেউ আপত্তি করে থাকে তবেই বিয়ে সম্পন্ন করা যাবে।
বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ এর অধীন বিয়ে একটি দেওয়ানী চুক্তি সুতরাং সম্মতি অত্যন্ত জরুরী। এর ১১ ধারায় বলা আছে, বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে রেজিস্ট্রার এবং ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদানকারী তিনজন সাক্ষীর সামনে। বিয়ের দুই পক্ষ রেজিস্ট্রার ও তিনজন সাক্ষীর সামনে “আমি ‘ক’ কে আইনত স্ত্রী/ স্বামী হিসেবে গ্রহণ করছি”- এই রকম ঘোষণা দেবে। এই ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্মে যেমন মহিলা সাক্ষী হলে হবেনা, কিংবা দুইজন মহিলা মিলে একজন পুরুষের সমান এই ধরণের বিধান নেই। তাছাড়া, এই আইনের অধীনে অনুষ্ঠিত বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয় এবং এজন্য নির্দিষ্ট রেজিস্ট্রার বই আছে।
বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ এর ২২ নং ধারা অনুসারে, সহ-উত্তরাধিকারিত্বের ওপর কতিপয় বিয়ের ফলাফল হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মাবলম্বী কোনো যৌথ পরিবারের কোনো সদস্যের এ আইন মোতাবেক বিয়ে হলে অনুরূপ পরিবার থেকে তার বন্ধন ছিন্ন হয়েছে বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ, যেহেতু বিশেষ বিবাহ আইনে বিবাহ মানেই হচ্ছে আপনি নিজেকে কোন ধর্মের অনুসারে নন বলে ঘোষণা দিচ্ছেন, সেহেতু হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মাবলম্বী কোনো যৌথ পরিবারের কোনো সদস্যেরবিশেষ বিবাহ আইনের অধীন বিবাহ হলে, ঐ ব্যক্তির ঐ যৌথ পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের কোনো মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন নন বা তাদের একজন যে কোনো একটি বা অন্য ধর্মে বিশ্বাসী তাদের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে হলে বিশেষ বিবাহ আইনের অধীন উপযুক্ত বিবাহের ক্ষেত্রে ধর্ম ত্যাগ করা আবশ্যিক। দুই পক্ষই ধর্ম ত্যাগ না করলে বিয়েটি বাতিল বলে গণ্য হবে।
বিশেষ বিবাহ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তান যদি এ আইনের অধীনেই বিয়ের ইচ্ছা পোষণ করেন, তবে তার পিতা বিয়ের ক্ষেত্রে যে আইনে রক্ত-সম্পর্কীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় বাধার সম্মুখীন ছিলেন, সে আইন এবং এ আইনের ২ ধারা তাঁর ওপর প্রযোজ্য হবে। এ আইনের কোনো কিছুই এ আইনের অধীনে বিয়ের ফলে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের অন্য কোনো আইনে সম্পাদিত বিয়ের বৈধতা ক্ষুণ্ন করবে না।
হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈন ধর্মে বিশ্বাসী কোনো ব্যক্তি, যিনি এ আইনের অধীন বিয়ে করেছেন, তার সম্পত্তির এবং এ বিয়ের ফলে জাত সন্তানের সম্পত্তির উত্তরাধিকার ‘উত্তরাধিকার আইন, ১৯২৫’ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হবে। ওই দুই ব্যক্তির মধ্যে এ বিয়ে হতে পারে, যাঁদের কেউই মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি, পার্সি, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মে বিশ্বাস করেন না। কিংবা ওই দুই ব্যক্তির মধ্যে এ বিয়ে হতে পারে, যাদের প্রত্যেকেই এর একটি বা অন্য ধর্মে বিশ্বাস করেন হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন। এ ছাড়া যেসব ব্যক্তি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ বা জৈন ধর্মে বিশ্বাসী, এ আইন দ্বারা তাদের জন্য বিয়ের বিকল্প একটি ধরন নির্ধারণ করা হয়েছে। আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন, যেসব বিয়ের বৈধতা সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে, সেসব সুনির্দিষ্ট বিয়ের বৈধতা দেয়া হয়েছে এ আইন দ্বারা।
একটি মজার এবং ব্যতিক্রমী বিষয় হচ্ছে বিশেষ বিবাহের সবকিছুই যখন এই আইনের অধীনে হচ্ছে, তখন বিবাহ বিচ্ছেদটা হচ্ছে অন্য আইনের অধীন। বিশেষ বিবাহ আইনের ১৭ ধারায় বলা আছে এই আইনের অধীনে বিয়ে করলে বিয়ে বিচ্ছেদের সময় ১৮৬৯ সালের “ডিভোর্স আইন” দ্বারা বিয়ে বিচ্ছেদ সম্পাদন করতে হয়। পুরোপুরি না হলেও এই আইনে কিছুটা নারী-পুরুষের সমতা রয়েছে। সুতরাং এখনেও একটি স্বতন্ত্র পারিবারিক আইন অনুসরণ করতে হচ্ছে। অর্থাৎ, দুই পক্ষের কারও উপরই অন্যায় করা হবে না।
এ আইন দ্বারা নির্দেশিত কোনো ঘোষণা বা প্রত্যয়নপত্র তৈরি করেন, স্বাক্ষর করেন বা সত্যায়ন করেন, যা মিথ্যা বর্ণনা, এবং তিনি জানেন ও বিশ্বাস করেন মিথ্যা বলে, বা সত্য বলে বিশ্বাস করেন না, এমন কোনো ব্যক্তি দণ্ডবিধির ১৯৯ ধারায় অপরাধী বলে বিবেচিত হবেন।
উপরের পুরোটাই আইন হলেও পরিশেষে খানিকটা মানবতা দিয়েই শেষ করছি। মানুষে মানুষে প্রেম, ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবী এখনো বেঁচে আছে। আর, আইনের জন্য মানুষ নয়, মানুষের জন্যই আইন। তাই তো বলে, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
লেখক : শিক্ষানবিশ আইনজীবী।
ই-মেইল : tanbir921535513@gmail.com