সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান (প্রধান বিচারপতির পদমর্যাদা ও সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগরত) সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক প্রথমে কোনো বক্তব্য না দিয়ে কমিশনের প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা অথবা প্রটোকল অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। তারা মিডিয়ার কাছে কোনো বক্তব্য দিতে চান নাÑ উল্লেখ করা হলে বিচারপতি এ বিএম খায়রুল হক এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘তাহলে আমার তো কোনো কিছুই বলার নেই।’ যে কাজগুলো আপনারা করছেন, কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, সেটি দেখার দায়িত্ব আপনার নয়কি- এমন প্রশ্নে এবিএম খায়রুল হক বলেন, ‘দেখেন, যে কাজগুলো করা হয়েছে; সেগুলো আমাদের ওয়েবসাইটেই আছে।’ ওগুলো তো ওয়েবসাইটেই পড়ে আছে, বাস্তবায়ন নেই- এমন প্রশ্নে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘তাহলে তো আমাদের কিছুই করার নেই। আমাদের কাজ হচ্ছে সুপারিশ করা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া।’
এদিকে গত মে মাসে অবসরে যাওয়া আইন কমিশনের সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. শাহআলম ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমি ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো কমিশনে যোগ দিয়েছিলাম। ওই সময় ১৩ মাসে কয়েকটি সুপারিশ পাঠানো হয়েছিল; কিন্তু সেগুলো আমলে না নেওয়ায় আমি কমিশন ত্যাগ করেছিলাম। এরপর ২০০৯ সালে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ আমাকে আবার যোগদানের জন্য বলেন। তখন ক্ষোভের কথা বললে, সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হবে- আমাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল; কিন্তু সেটি আর হয়নি। প্রফেসর শাহআলম আরও বলেন, বিগত ২২ বছরে কমিশন থেকে দেড়শর মতো সুপারিশ পাঠানো হয়েছে। তার মধ্যে সরকার আনুমানিক ৫ থেকে ৬টি বাস্তবায়ন করেছে। এ বিষয়টি নিয়ে আমি ২০১৬ সালে ‘বাংলাদেশের আইনের সংস্কার ও আইন কমিশন’ শিরোনামে একটি বই লিখেছি। ওই বইয়ে কমিশনের সুপারিশ যে বাস্তবায়ন করা হয় না, সে ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছি। আইন মন্ত্রণালয় থেকে অধিকাংশ সুপারিশ আমলে না নেওয়ায় জনগণ সেই বেনিফিটটা পাচ্ছে না। তবে যেসব উচ্চমানের গবেষণা কমিশনে হচ্ছে, এগুলোর রিসার্চ ভ্যালু আছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি ‘স্বাস্থ্যসেবা আইন’ প্র্রণয়নসংক্রান্ত আইনের খসড়া প্রণয়ন করে তার আলোকে আইন তৈরির সুপারিশ করে কমিশন। এই সুপারিশ তৈরির জন্য ২০১৪ সাল থেকে গবেষণাকার্যক্রম শুরু করা হয়। এই সুপারিশ তৈরির জন্য কমিশনের গবেষক দল রাজশাহী ও চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের শিক্ষাদান ও চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম সরেজমিন প্রত্যক্ষ করে এবং উপযুক্ত মেডিক্যাল কলেজগুলো নিযুক্ত চিকিৎসকদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়সহ বর্তমান আইনে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন সূক্ষ বিষয় সম্পর্কে ধারণা অর্জন করে। এ ছাড়া আইন কমিশন বরেণ্য চিকিৎসক, জাতীয় অধ্যাপকসহ চিকিৎসা সেবাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করে। দীর্ঘ প্রায় ৩ বছরের প্রক্রিয়া শেষে কমিশন এই আইনের খসড়া তৈরি করে আইন তৈরির জন্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায়; কিন্তু সেটিও আলোর মুখ দেখেনি।
একইভাবে সাক্ষী সুরক্ষা, বৈষম্য বিলোপ, মিথ্যা মামলা প্রতিরোধ, সুপ্রিমকোর্টের বিচারক নিয়োগ, চিকিৎসায় অবহেলা দূর, শারীরিক শাস্তির বিধান বাতিল প্রভৃতি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বতন্ত্র আইন প্রণয়নের সুপারিশ করে প্রতিবেদন দিয়েছে আইন কমিশন। কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও ওই সুপারিশগুলো আইনে পরিণত হয়নি।
আইন মন্ত্রণালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ‘আইন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিষয়ে আসলে মন্ত্রণালয়ের তেমন কিছু করার নেই। মন্ত্রণালয় এখানে শুধু ডাকবাক্সের (পোস্টবক্স) ভূমিকা পালন করে। আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের বিষয়টি পুরোপুরি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে।’ তবে এ ব্যাপারে বারবার চেষ্টা করেও আইন মন্ত্রণালয়ের কারো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল বেশিরভাগ দেশে নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইনের সংস্কারে তাদের আইন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ ল কমিশন বা ভারতের আইন কমিশন খুব কার্যকর সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যে পৃথক আইন কমিশনের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকারের একটি আলাদা ইউনিফর্ম ল কমিশন আছে।
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের মতে, ‘উন্নত বিশ্বের সঙ্গে আমাদের প্রধান পার্থক্য হলোÑ তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীন ও কার্যকর, আমাদেরগুলো নয়। যে দেশের প্রতিষ্ঠান যত কার্যকর ও শক্তিশালী, সে দেশ সংকট মোকাবিলায় ততটাই পারদর্শী। সরকারের মধ্যে একটি ভ্রান্ত ধারণা আছে, সব ক্ষমতা তাদের হাতে রাখতে হবে। এ জন্যই আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর হচ্ছে না। আইন কমিশন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বা এ ধরনের যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই এটি হচ্ছে।’