প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য ৩১ বছর আগে নূর মোহাম্মদ নামে এক কৃষি শ্রমিককে কুষ্টিয়ার বংশী তলায় তার মালিক নিজেই হত্যা করেছিলেন। যিনি এই হত্যা মামলার বাদী ছিলেন,তাকেসহ ১০ জনকে আসামি করে সম্প্রতি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। তবে ইতোমধ্যে দুই আসামির মৃত্যু হয়েছে এবং জীবিত আসামিরা বার্ধক্যজনিত কারণে শয্যাগত। অভিযুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন রাতে কুষ্টিয়ার বংশী তলায় খুন হন নূর মোহাম্মদ নামে একজন দিন মজুর। ওই সময় এই হত্যা মামলার বাদী হন নূর মোহাম্মদ যে বাড়িতে কাজ করতেন, সেই বাড়ির মালিক মাজেদ আলী জোয়ার্দার। ঘটনার ৩১ বছর পর কুষ্টিয়ার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে বেরিয়ে এসেছে যে, নূর মোহাম্মদের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন তারই মালিক মাজেদ আলী জোয়ার্দারসহ ১০ জন। এদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে কুষ্টিয়া জেলা পিবিআই’র পরিদর্শক শেখ মোনায়েম হোসেন।
তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘গত ৩১ বছরে এই মামলাটি পুলিশের তিনটি ইউনিট তদন্ত করেছে। কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ, সিআইডি ও পিবিআই। অবশেষে প্রকৃত হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। মূলত এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এই হত্যা সংঘটিত হয়েছে।’
যেভাবে নূর মোহাম্মদকে খুন করা হয়
নূর মোহাম্মদ ছিলেন কুষ্টিয়ার সদর থানার বংশী তলা গ্রামের বাসিন্দা। তিনি দৈনিক মজুরিতে এলাকায় ধনী পরিবারের ক্ষেতে কৃষিকাজ করতেন। মাজেদ আলী জোয়ার্দারের বাড়িতেও কাজ করতেন তিনি। নূর মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর একই এলাকার তহুরুন্নেসাকে বিয়ে করেন। তিনি তার ছেলে আমিরুল ইসলামকে নিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীর বাবার বাড়িতেই থাকতেন। ১৯৮৭ সালের ২৪ জুন রাতে মাজেদ আলী কাজের কথা বলে নূর মোহাম্মদকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আসেন। এসময় নূর মোহাম্মদকে তার ১২ বছরের ছেলে আমিরুল কুপি (বাতি) নিয়ে এগিয়ে দেয়। পরের দিন (২৫ জুন) সকালে নূর মোহাম্মদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। এই ঘটনায় মাজেদ আলী ওই দিনই বাদী হয়ে কুষ্টিয়া সদর থানায় মামলা দায়ের করেন।
৩১ বছরে তদন্তে যা ঘটেছে
হত্যার পর নূর মোহাম্মদের পরিবারের কেউ মামলা করেনি। তিনি যে বাড়িতে কাজ করতেন সেই বাড়ির মালিক মাজেদ আলী জোয়ার্দার বাদী হয়ে ১৯৮৭ সালের ২৫ জুন কুষ্টিয়া সদর থানায় একটি হত্যা মামলা (মামলা নম্বর ২৬) দায়র করেন। মামলায় একই এলাকার আলতাফ মোল্লাসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়। কুষ্টিয়া থানা পুলিশ প্রথমে মামলাটি তদন্ত করে। সদর থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) নিখিল কুমার ও পরিদর্শক আব্দুস সোবহান ছিলেন মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা। কুষ্টিয়া জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনায় ১৯৮৭ সালের ১১ জুলাই মামলাটি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)-কে দেওয়ার জন্য সুপারিশ করেন। ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া জেলা সিআইডির পরিদর্শক আব্দুল বারেক মামলাটি তদন্ত শুরু করেন। মামলার তদন্ত চলাকালীন বাদী মাজেদ আলী জোয়ার্দার বুঝতে পারেন যে, তদন্তের ফল তার বিপক্ষে যাচ্ছে। তিনি তখন নিহত নূর মোহাম্মদের দ্বিতীয় স্ত্রী তহুরুন্নেসাকে দিয়ে মামলাটির সঠিক তদন্ত হচ্ছে না উল্লেখ করে আদালতে একটি ফৌজদারি মিস মামলা করান। ১৯৮৮ সালের ২৬ এপ্রিল আদালত উভয় পক্ষের শুনানি শেষে তহুরুন্নেসার দায়ের করা মামলাটি খারিজ করে দেন। সিআইডি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুল বারেক পুনরায় মামলা তদন্ত শুরু করেন। তবে মামলার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে নূর মোহাম্মদের দ্বিতীয় স্ত্রী হাইকোর্টে ফের মিস মামলা (মামলা নম্বর ৩১/১৯৮৮) করেন। সেসময় যশোরেই ছিল হাইকোর্ট। পরবর্তীতে ২০০৪ সালের ৪ নভেম্বর শুনানি শেষে বাদীর মিস মামলাটি খারিজ করে দেন হাইকোর্ট। তবে এই একযুগে মামলাটির তদন্ত স্থগিত থাকে। মিস মামলা খারিজ হওয়ার পর সিআইডি পুনরায় তদন্ত শুরু করে। সিআইডির ১১ জন কর্মকর্তা এ মামলা তদন্ত করেন। সিআইডির তদন্তে স্পষ্ট হতে থাকে যে, মূলত প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্যই এই হত্যা ঘটানো হয়েছে। সিআইডি তাই নূর মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রীর ছেলে মো. আমিরুল ইসলামকে দিয়ে ২০০৫ সালের ৩০ জানুয়ারিতে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে একটি হত্যা মামলা (মামলা নম্বর ০২/২০০৫) দায়ের করায়। আমিরুলের দায়ের করা মামলায় মাজেদ আলী জোয়ার্দার (৯৪), মোহাম্মদ কুদ্দুস জোয়ার্দার (৯০), গোলাম কিবরিয়া (৬৫) ও মোহাম্মদ কালাম (৬০)সহ ১০ জনকে আসামি করা হয়। পরবর্তীতে সিআইডি ২০০৫ সালের ৩০ এপ্রিল মূল মামলাটি তদন্ত শেষে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। অপরদিকে, নূর মোহাম্মদের ছেলের আদালতে দায়ের করা মামলাটিকে কুষ্টিয়া থানায় নিয়মিত মামলা (নম্বর ৪৫) হিসাবে দায়ের করানো হয়। সিআইডির এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধেও মাজেদ আলী আদালতে নারাজি দেন। ফলে ২০১২ সালের ১৪ জুন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত ১-এ শুনানি মঞ্জুর করে মামলার নথি নিম্ন আদালতে পাঠান। ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মামলাটি সেখানেই আদেশের অপেক্ষায় থাকে। ওই দিনই (৭ সেপ্টেম্বর) আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে পাঠান। পিবিআই ২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করে। তদন্ত শেষে নূর মোহাম্মদ হত্যা মামলায় অভিযোগ দাখিল করেন পিবিআই তদন্ত কর্মকর্তা। নূর মোহাম্মদের ছেলে আমিরুল ইসলামসহ আরও দুই ব্যক্তি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন- মোহাম্মদ আলী ও ইয়াকুব আলী। তাদের জবানবন্দিতেও এই হত্যার সঙ্গে মাজেদ আলীর জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। ঘটনার সময় আমিরুলের বয়স ছিল সাত বছর। ঘটনার রাতে তার সামনে থেকেই নূর মোহাম্মদকে ডেকে নেন মাজেদ আলী। এসময় কুপি (বাতি) দিয়ে আমিরুল তার বাবাকে এগিয়ে দিয়েছিল।
অভিযুক্তরা সবাই বৃদ্ধ, দু’জন বেঁচে নেই
পিবিআই দায়িত্ব পাওয়ার পর নূর মোহাম্মদ হত্যায় দায়ের করা দুটি মামলার তদন্ত করে। এবছরের ২ অক্টোবর পিবিআই মাজেদ আলী জোয়ার্দারের দায়ের করা মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। অপরদিকে, নূর মোহাম্মদের ছেলের দায়ের করা মামলাটির তদন্ত শেষে মাজেদ আলী জোয়ার্দারসহ ১০ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। ১০ আসামির মধ্যে দুই আসামি মারা গেছেন। আর জীবিত সবাই বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছেন। আদালত ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
তদন্ত কর্মকর্তার বক্তব্য
তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই’র পরিদর্শক শেখ মোনায়েম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আশির দশকে কুষ্টিয়ার বংশী পাড়া এলাকায় দু’টি গ্রুপ ছিল। একটি মাজেদ আলী জোয়ার্দার গ্রুপ, অপরটি আলতাফ মোল্লা গ্রুপ। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ওই সময় দু’টি গ্রুপের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হতো। ১৯৮৬ সালের মার্চে আলতাফ মোল্লা গ্রুপের একজন খুন হন। ওই মামলায় মাজেদ জোয়ার্দারকে আসামি করে আলতাফ মোল্লা মামলা করেন। তখন সেই মামলা থেকে রেহাই পেতে এবং প্রতিপক্ষকে চাপে ফেলতে নিজের কাজের লোক (নূর মোহাম্মদ)-কে খুন করে মাজেদ জোয়ার্দার।’
তিনি বলেন, ‘বর্তমানে এলাকায় এই দুই গ্রুপের কোনও প্রভাব নেই। তারা সবাই বৃদ্ধ হয়ে গেছেন।’
-বাংলা ট্রিবিউন