সিরাজ প্রামাণিক
২০০০ সালে প্রণীত আমাদের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ ধারায় নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশে বাঁধা-নিষেধ রয়েছে। ১৪(১) ধারায় বলা হয়েছে যে, নারী নির্যাতন সংক্রান্ত সংবাদ এমনভাবে ছাপাতে হবে, যাতে ওই নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়। ১৪ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো সংবাদপত্রে নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় ছাপানো হয়, তবে তার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের প্রত্যেকে সর্বোচ্চ দুই বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা তিনি বা তারা উভয়দণ্ডেদণ্ডিত হতে পারেন।
একটি কেইস ষ্টাডি তেকে জানা যায়, ২০০১ সালে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে ওই সময়ের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধে ঢাকার মিরপুর থানায় মামলা করেন এক নারী। ওই মামলার বাদীর ছবি প্রকাশ করে ২০০২ সালের ৪ ও ৫ জানুয়ারি জনকণ্ঠে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯ জানুয়ারি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধনী-২০০৩) আইনের ১৪ (১) ও (২) ধারায় জনকণ্ঠ সম্পাদকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন ওই নারী।
মামলায় তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামীদের বিরুদ্ধে ২০০২ সালের ১৯ জুন অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই মামলায় জনকণ্ঠ সম্পাদক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ, উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান, তখনকার নির্বাহী সম্পাদক বোরহান উদ্দিন আহমদসহ (মৃত) ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেন বিচারিক আদালত। এরপর ওই মামলা বাতিল চেয়ে জনকণ্ঠ সম্পাদকসহ অন্যরা ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্টে আবেদন করেন। এর আগের বছরই তারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন পান।
আবেদনের প্রাথমিক শুনানি গ্রহণ করে ২০০৩ সালে হাইকোর্ট রুল ও স্থগিতাদেশ দেয়। পরে ওই রুলে পক্ষভুক্ত হন মামলার বাদী ওই নারী। রুলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ১৭ এপ্রিল আদালত তা খারিজ করে রায় দেন। এর ফলে নিম্ন আদালতে এই মামলা চলতে আর কোনো বাঁধা থাকে না।
অন্যদিকে ২০১৩ সালে প্রণীত শিশু আইনের ৮১ ধারায় সংবাদ মাধ্যম কর্তৃক কোনো গোপন তথ্য প্রকাশের দণ্ড প্রদান সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই ধারা অনুসারে, শিশু আইনের অধীনে বিচারাধীন কোনো মামলা বা বিচার কার্যক্রম সম্পর্কে প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মাধ্যম অথবা ইন্টারনেটের মাধ্যমে কোনো শিশুর স্বার্থের পরিপন্থী এমন কোনো প্রতিবেদন, ছবি বা তথ্য প্রকাশ করা যাবে না যার মাধ্যমে শিশুটিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়।
কোনো ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে তা আইনের অধীনে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং এই অপরাধের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনধিক এক বছর কারাদণ্ড কিংবা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয়দণ্ডেদণ্ডিত হতে পারেন। কোনো কোম্পানি, সমিতি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান এই বিধান লঙ্ঘন করলে সেই কোম্পানি, সমিতি, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন অনধিক দুই মাসের জন্য স্থগিত রাখাসহ সেটিকে অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে। আগের আইনে বিশেষ অবস্থা বিবেচনায় আদালত নাম-পরিচয় প্রকাশের অনুমতি দিতে পারলেও নতুন আইনে সেই বিধান রাখা হয়নি।
তবে নিরাশা ও হতাশার কথা হলো, নির্যাতিত নারী ও শিশুদের ঘটনা এমনভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে যে, তাতে তার পরিচিতরা তো বটেই কেউ চাইলে তাদের নাম ঠিকানা সবই বের করে ফেলতে পারেন। আবার অনেক সময় সংবাদ মাধ্যম বিশেষ করে প্রিন্ট ও অনলাইন মিডিয়ায় নির্যাতিত নারী ও শিশুর প্রতীকী ছবি ব্যবহার করে থাকে। সেই ছবি দিয়ে তারা কী বোঝাতে চান তাও স্পষ্ট নয়। নির্যাতিত ছবি প্রকাশ করা বা ছাপা আইনে নিষিদ্ধ। তাঁর নাম পরিচয় প্রকাশ করাও বেআইনি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৪ (১)- এ বলা হয়েছে- ‘এই আইনে বর্ণিত অপরাধের শিকার হয়েছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোনও সংবাদপত্রে বা অন্যকোনও সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।’
এই আইনের সারমর্ম হল- এমন কোনও তথ্য বা ছবি প্রকাশ করা যাবে না যাতে নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ পায়। কিন্তু এই সারমর্ম বুঝতে পারছে না অনেক সংবাদ মাধ্যম। তারা মনে করে ছবি ও নাম ঠিকানা প্রকাশ না করলেই হলো। অথচ ঘটনার শিকার নারীর ছবি বা নাম ঠিকানা প্রকাশ না করলেও ঘটনাস্থল, কর্মস্থল এবং তাঁর আত্মীয় স্বজনের উদ্ধৃতি এমনভাবে দেওয়া হচ্ছে যে, তাতে নারীর পরিচয় প্রকাশের আর বাঁকি থাকছে না। নির্যাতিত নারী ও শিশুর ডাক্তারি পরীক্ষা কোথায় হবে, কীভাবে হবে, তিনি এখন কোথায় আছেন তার বর্ণনা পত্রিকা এমনভাবে প্রকাশ করছেন যেন চাইলে যেকেউ ভূক্তভোগীকে একবার দেখে আসতে পারেন।
আর ধর্ষণ ছাড়া নারী ও নিশু নির্যাতন আইনের অন্য ঘটনায় আইনটি একবারেই মানছে না সংবাদ মাধ্যম। যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন, পাচার বা ইভটিজিং-এর ঘটনায় আমরা দেখি, ঘটনার শিকার নারী বা শিশুর ছবি এবং নাম ঠিকানা ছাপা হয় অবাধে। আর বর্ণনাও রগরগে। অথচ নারী ও শিশু নির্যাতন নিয়ে সংবাদ প্রকাশের যতগুলো উদ্দেশ্য থাকে তার মধ্যে একটি হলো ঘটনার শিকার নারী ও শিশুকে সহয়তা করা। তাকে ন্যায় বিচার পেতে, অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করা। মানুষকে সচেতন করা এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা। কিন্তু নারী বা শিশুর আক্ষরিক পরিচয় না দিয়ে কৌশলে তার বাবা-মা, কর্মস্থল বা চিকিৎসা কেন্দ্রের নাম ঠিকানা প্রকাশ করার আসল উদ্দেশ্য কী?
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশ থেকে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়া বিরত রয়েছে। সেদিন থেকে নারী দ্বিতীয়বার সংবাদ মাধ্যমে আর ধর্ষণের শিকার হবেন না। উল্লেখিত আইনের চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।