অমিত দাশ গুপ্ত :
১৯৭২ সালের ৪ ঠা নভেম্বর স্বীয় অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে জাতি রাষ্ট্র হিসাবে বাঙালী নিজের জন্য প্রণয়ন ও গ্রহণ করে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দলিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান। যার প্রস্তাবনায় এক বাক্যে রাষ্ট্রের জন্মবৃত্তান্ত তুলে ধরে বলা হয়েছে এভাবে ”আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।”
সংবিধানের প্রথম ভাগে প্রজাতন্ত্র শিরোনামে ৭ম অনুচ্ছেদে সংবিধানকে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন অভিহিত করে ঘোষণা করা হচ্ছে যে, অন্য কোন আইন সংবিধানের সাথে অসমঞ্জস হলে তা যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হবে।
জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মরিপেক্ষতা এই চারটিকে মূলনীতি গণ্য করে সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ৮ থেকে ২৫ অনুচ্ছেদ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহ বর্ণিত হয়েছে। মূলতঃ ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালী জাতীয়তাবাদ; সেটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মানুষের উপর মানুষের শোষণমুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজলাভ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতাকে ভিত্তি গণ্য করে ঘোষণা করা হয়েছে যে, প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র এবং সেখানে সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মের রাজনৈতিক মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, ধর্মের জন্য ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বিলোপ করা হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি অধ্যায় অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা এবং মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা করার পাশাপশি কৃষক-শ্রমিক ও গ্রামীন উন্নয়নের জন্য দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এই অধ্যায়ে বর্ণিত মূলনীতি সমুহ আদালতের মাধ্যমে বলবৎ করা যায় না, কিন্তু রাষ্ট্র ও নাগরিকদের কার্যের ভিত্তি হিসাবে গন্য হয় এবং সংবিধান ও অন্যান্য আইনের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়। দ্বিতীয় ভাগের অনুচ্ছেদ ২৫ এ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভূমিকা কি হবে সেই বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
আমাদের সংবিধানের মূল আকর্ষণ এর তৃতীয় ভাগ; যেখানে মৌলিক অধিকারের সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। মানবাধিকারের ধারণা থেকে গৃহীত সমতার অধিকার, আইনগত অধিকার, জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, বিচার প্রাপ্তির অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক্-স্বাধীনতা, সম্পত্তি, গৃহ ও যোগাযোগের অধিকার সমুহ মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পেয়েছে; নিষিদ্ধ করা হয়েছে জবরদস্তি- শ্রম। সংবিধানের ৪৪ এবং ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মৌলিক অধিকার বলবৎকরণের জন্য কিংবা বিচারবিভাগীয় পুনঃবিবেচনার নিমিত্তে সুপ্রীম কোর্ট এর হাইকোর্ট বিভাগে পিটিশন দায়ের করার বিধান করা হয়েছে; যা রীট পিটিশন নামে অভিহিত। রাষ্ট্র সংবিধানের তৃতীয় ভাগে বর্ণিত অধিকার সমুহের পরিপন্থি কোন আইন প্রণয়ন করতে পারে না বিধায় মৌলিক অধিকার সমুহ পরিনত হয়েছে নাগরিকদের রক্ষাকবজে। তবে জরুরী পরিস্থিতিতে সংবিধানের ১৪১(ক)-(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মৌলিক অধিকার ভোগের উপর বাধা নিষেধ আরোপ করা যায়। মানবতা বিরোধী অপরাধ, গন হত্যা জনিত অপরাধ ও যুদ্ধ অপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার প্রযোজ্য হয় না।
সংবিধানের চতুর্থ ভাগে শাসন বিভাগের কাঠামো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থায় থাকছেন রাষ্ট্রপতি যিনি মূলতঃ তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রপ্রধান কিন্তু সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। চতুর্থ ভাগে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদ এদের ক্ষমতা, কার্যবলী, মেয়াদ আলোচনার পাশাপশি স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত বিষয়াবলী, প্রতিরক্ষা কর্মবিভাগ, অ্যাটর্নি জেনারেল ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত মূল ক্ষমতা সংসদের হাতে অর্পণ করে সংবিধানের পঞ্চম ভাগে আইন বিভাগ গঠন করা হয়েছে। অর্থ সংক্রান্ত মূল কাজ বাজেট অনুমোদন সংসদের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে বা সংসদ ভেঙ্গে যাওয়া অবস্থায় আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৯৩ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির নিকট রাখা হয়েছে। তবে অধ্যাদেশ এর মাধ্যমে প্রণিত আইন সংসদের অনুমোদন ব্যতীত নিদিষ্টি মেয়াদান্তে কার্যকর থাকে না।
বিচার বিভাগ হলো লিখিত সংবিধানের অভিভাবক। সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগে আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের সম্বন্বয় সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠা করে অধস্তন আদালত ও প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল এর বিধান করা হয়েছে। বিচার বিভাগ মূলতঃ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকভাবে বিচার কার্য পরিচালনার পাশাপাশি আইনের বৈধতা যাচাই করে আর মৌলিক অধিকার বলবৎকরণের আইনী ব্যবস্থা নেয়।
গনতন্ত্রের পূর্বশর্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। সংবিধানের সপ্তম ভাগে নির্বাচন সমুহ পরিচালনার জন্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংবিধানের অধীনে থেকেই নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে বিতর্ক মূক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব।
আমাদের সংবিধান লিখিত ও দুষ্পরিবর্তনীয় হলেও সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন সাপেক্ষে সংসদকে প্রদান করা হয়েছে; তবে তা ৭খ অনুচ্ছেদের বিধান অনুসরণে করতে হয়; তবে এক্ষেত্রে সংবিধানের মৌল কাঠামো পরিবর্তীত হয় এমন কোন সংশোধন করা যায় না।
স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম, ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ, ৩৪ সদস্যের সংবিধান প্রনয়ণ কমিটি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও নিদের্শনা এবং সর্বোপরি বাংলার জনগনের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে বাঙালীর আত্ম পরিচয়ের মূল দলিল সংবিধান প্রণীত হয়। ইতোমধ্যে ১৬ টি সংশোধনী গৃহীত হলেও ৫ টি সংশোধনী আদালত কর্তৃক আশিংক বা সম্পূর্ণরূপে বাতিল ঘোষিত হয়েছে। কখনো কখনো অসাংবিধানিক পন্থায় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত পূর্বক জারি করা হয়েছে সামরিক শাসন। কিন্তু সংবিধানের কোথাও সামরিক শাসনের বিধান নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার জীবন বিধান হিসাবে সংবিধান বাঙালীর আত্ম পরিচয়ের মূল দলিলে পরিণত হয়েছে। তাই সংবিধানের পাঠ এবং শিক্ষা প্রতিটি নাগরিকের জন্য অত্যাবশ্যকীয়।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।