জাহিদ হোসেন
আজ আপনাদের জানাবো বৃটিশ ভারতে প্রথম ফাঁসির মামলা, প্রথম বিচারিক হত্যা (Judicial Killing)। যে মামলাটি ভারতবর্ষ তো বটেই ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট পর্যন্তও গড়িয়েছিল। ১৭৬৩ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন বর্ধমান, নদীয়া ও হুগলী জেলার কালেক্টর। বিভিন্ন জমিদারদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায়সহ মীরজাফরের স্ত্রীর কাছ থেকে ৩ লক্ষ ৫৪ হাজার টাকা ঘুষ গ্রহনের বিষয় প্রকাশ পাওয়ায় এবং ঘুষখোর, স্বৈরাচারী, নিষ্ঠুর ও অসাধু হেস্টিংসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আসায় তিক্ত বিরক্ত হয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী, তাকে পদচ্যুত করে ইংল্যান্ডে ফেরৎ পাঠায়। তার স্থলাভিসিক্ত হন নন্দ কুমার। নন্দকুমারের সততায় মুগ্ধ হয়ে মোগল সম্রাট ২য় শাহ আলম তাকে মহারাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। (তবে ইতিহাস থেকে জানি, তিনি বাংলার শেষ নবাবকে হত্যার সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। আমি অনেক বইয়ে তার নাম দেখলাম যে সেও জড়িত ছিল বিশ্বাসঘাতকের তালিকায়। নাকি এটা ইংরেজদের ইতিহাস বিকৃতি যাতে করে নন্দ কুমারকে পরবর্তীতে লোকে আসলেই ভিলেন জানে)
এই ঘটনায় হেস্টিংসের মনে তীব্র অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। ১৭৭৩ সালে হেস্টিংস ২য় বার ভারতে এলেন গভর্ণর জেনারেল হয়ে। এসেই জনসমাজে প্রভাবশালী নন্দ কুমারকে বশে রাখতে তাকে ৩ লক্ষ টাকা উৎকচ দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন একটি পত্রের মাধ্যমে।
সত্যনিষ্ঠ নন্দ কুমার এই ঘটনায় বিরক্ত হয়ে তার বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে মামলা করেন। সুপ্রীম কাউন্সিল অব বেঙ্গল এর সদস্য জাস্টিস স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস এই মামলার বিচার করেন।
নন্দ কুমার ওয়ারেন হেস্টংস এর হাতে লেখা চিঠি কোর্ট এক্সিবিট হিসাবে দাখিল করলেও কোর্ট তা আমলে না নিয়ে ওয়ারেন হেস্টিংসকে খালাস দেন। খালাস পেয়েই মোহন প্রসাদ নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে মহারাজা নন্দ কুমারের বিরুদ্ধে একটি বন্ড জালিয়াতির মামলা করান সুপ্রীম কোর্টে। তখন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন এলিজা ইম্পে। যিনি ছিলেন ১৭৭৩ সালের রেগুলেটিং অ্যাক্ট এর আওতায় প্রতিষ্ঠিত কলকাতা সুপ্রীম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি।
তিনি হেস্টিংস এর সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন। বিচারে ইম্পেই নন্দ কুমারকে মৃত্যুদন্ড দেন ৫ আগষ্ট ১৭৭৫ সালে। সেই দিনই মহারাজা নন্দ কুমারের ফাঁসী কার্যকরী হয়। নন্দকুমারকে ফাঁসি দেওয়ার জন্য হেস্টিংস মোড়ে (তৎকালীন কুলি বাজারে) খোডা হয় কুয়ো। ১৭৭৫ সালের ৫ অগস্ট জনসমক্ষে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল মহারাজা নন্দকুমারকে। ব্রিটিশ শাসনকালে এটিই ভারতবর্ষের সর্বপ্রথম ফাঁসি ছিল। এই হত্যাকে তখন আইনি খুনের আখ্যা দেওয়া হয়। যদিও, পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয় নন্দকুমার নির্দোষ ছিলেন। এই নিয়ে তৎকালীন বাঙালিদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, এটি একটি ‘আইনি খুন।’
অনেক দিন পরে প্রকৃত সত্য উদঘাটন হলে বৃটিশ পার্লামেন্ট হেস্টিংস ও ইম্পেইকে কমিটিং জুডিশিয়াল মার্ডার এর অভিযোগে তীব্র ভৎর্ষনা করে পদচ্যুত করেন। ধারণা করা হয় যে, হেস্টিংস মহারাজা নন্দকুমারকে শাস্তি দেওয়ার জন্য একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন এবং জনৈক মোহন প্রসাদ, মহারাজা নন্দকুমারের বিরুদ্ধ একটি জালিয়াতির মামলা রজু করলে সেই সুযোগটিকে তিনি কাজে লাগান।
সে সময় ইংল্যান্ডের আইনে ‘জালিয়াতি’ ছিল মৃত্যুদন্ড যোগ্য অপরাধ। ঐতিহাসিকগণ নন্দ কুমারের বিচারের এই রায়কে প্রধানত তিনটি দিক বিবেচনা করে একে একটি ‘বিচারিক হত্যা’ (Judicial Murder) বলে মত প্রকাশ করেছেন। প্রথমত, নন্দকুমারের বিরুদ্ধে আনীত মামলাটি দায়ের করা হয় কলকাতা সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠার চার বছর পূর্বে। দ্বিতীয়ত, মুসলিম এবং হিন্দু আইনে জালিয়াতি ছিল একটি খুব সাধারণ অপরাধ। তাছাড়া হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী একজন ব্রাহ্মণের বিরূদ্ধে আনীত অভিযোগে তাঁকে কখনও মৃত্যুদন্ড দেওয়া যায় না। ১৭৮৭ সালে স্যার ইম্পের বিরুদ্ধে হাউজ অব কমনস এ আনীত অনাস্থা প্রস্তাবটি খারিজ হয়ে যায়। হেসটিংস এবং স্যার ইম্পের এই ষড়যন্ত্রমূলক বিচারিক হত্যার বিরূদ্ধে ম্যাকলে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
বেভারিজ, স্যার আলফ্রেড লয়াল প্রমুখ ঐতিহাসিক মতে, হেস্টিংসের বিরুদ্ধে পরিষদের কাছে যখন একটার পর একটা অভিযোগ আসতে লাগল, তখন আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য হেস্টিংসকে নন্দকুমারের ফাঁসির ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। ভবিষ্যতে যাতে হেস্টিংসের বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ আনতে সাহস না পায় তার জন্য এরূপ ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। কারও কারও মতে, হেস্টিংস তার বাল্যবন্ধু প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে নন্দকুমারের ফাঁসির ব্যবস্থা করেছিলেন।
লেখক : আইন বিষয়ক লেখক ও অধিকার কর্মী।