বন্দিদের কাছে আসা স্বজনদের টাকার বিনিময়ে ভিআইপি পাস দেওয়া, জামিননামা আটকে টাকা আদায়, শীর্ষ অপরাধীদের জামিন লুকিয়ে রাখা ও সিট ভাড়া দেওয়া— কক্সবাজার জেলা কারাগার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ উঠেছে।
পুলিশ, আইনজীবী ও কারামুক্তদের দাবি, এই কারাগারে বিভিন্নভাবে চলছে রমরমা বাণিজ্য! এ কারণে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন বন্দিদের দেখতে আসা সাধারণ মানুষ।
কারাগার থেকে সদ্য জামিনে আসা অনেকের অভিযোগ, জামিনপ্রাপ্ত আসামির স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত জামিননামা আটকে রাখা হচ্ছে। সবশেষ গত ৪ জানুয়ারি বিকালে স্বজনদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের পর জামিননামা আটকে রাখা এক আসামিকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
কক্সবাজার জেলা জজ আদালতের আইনজীবী আবুল কাশেম গণমাধ্যমকে জানান, টেকনাফের গোদারবিল এলাকার ইউসুফ আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলম গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় ছয় মাস কক্সবাজার কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। দাম্পত্য কলহের জের ধরে তার স্ত্রী বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
গত ৩ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা জজ আদালতে মোহাম্মদ আলমের জামিন আবেদন করা হলে বিচারক তা মঞ্জুর করেন। ওইদিন দাফতরিক কাজের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় জামিননামা পাঠানো সম্ভব হয়নি কারাগারে। এর পরদিন ৪ জানুয়ারি সকালে আদালতের জামিন আদেশটি দাফতরিক সংশ্লিষ্ট নিয়মমাফিক অনুসরণ করে কারাগারে পাঠানো হয়।
আইনজীবী আবুল কাশেম গণমাধ্যমকে আরও নিশ্চিত করেন, আসামির স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, কারা কর্তৃপক্ষকে টাকা না দেওয়ায় মোহাম্মদ আলমকে ৪ জানুয়ারি বিকাল পর্যন্ত মুক্তি দেয়নি। পরে কারা কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে টাকা দেওয়ার পর ওইদিন বিকাল ৪টার দিকে আসামিকে জামিনে ছাড়া হয়।
জামিনে মুক্তি পাওয়া ওই আসামির ভাই খায়রুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আদালতের জামিন আদেশ ৪ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার কারাগারে পৌঁছায়। এরপরও বিকাল ৩টা পর্যন্ত কারা কর্তৃপক্ষ মোহাম্মদ আলমকে মুক্তি দেয়নি। এর মধ্যে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি ০১৮১৬৪০৭৪৫৯ নম্বর থেকে কল করে জানায়, আসামিকে ছাড়িয়ে আনতে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে ৩ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। পরে ওই ব্যক্তির কাছে টাকা দেওয়ার পর আমার ভাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
আসামি মোহাম্মদ আলমের আইনজীবী আবুল কাশেম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আদালতের আদেশনামা দাফতরিক সময়সূচির মধ্যে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানো মাত্রই সংশ্লিষ্ট আসামিকে ছেড়ে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ টাকা না দেওয়ায় দীর্ঘ ছয় ঘণ্টার বেশি আসামিকে আটকে রাখে।’
এমন ঘটনাকে আদালতের আদেশনামার প্রতি কারা কর্তৃপক্ষের অবজ্ঞা প্রদর্শন বলে মন্তব্য করেন এই আইনজীবী। তবে আদালতের আদেশনামার সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেক ক্ষেত্রে আসামিকে ছাড়তে সময়ক্ষেপণ হতে পারে বলেও জানান তিনি।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন কক্সবাজার জেলা কারাগারের জেল সুপার মো. বজলুর রশিদ। তার ভাষ্য, ‘আদালতের আদেশে জামিন পাওয়া আসামিকে টাকা না দেওয়ায় আটকে রাখার বিষয়ে আমি অবহিত নই। তবে খোঁজ-খবর নিয়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এদিকে কারাগার থেকে জামিনপ্রাপ্ত দাগী ও চিহ্নিত আসামিদের ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা মানছে না বলে অভিযোগ রয়েছে খোদ পুলিশের। এ কারণে জামিনপ্রাপ্ত চিহ্নিত অপরাধীরা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে না থাকায় কারাগার থেকে বেরিয়ে আবারও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
অভিযোগ রয়েছে, টাকার বিনিময়ে এসব দাগী ও চিহ্নিত অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে কক্সবাজার কারাগারে। গত এক মাসে জামিন পাওয়া অন্তত ডজনখানেক দাগী ও চিহ্নিত অপরাধীকে কক্সবাজার কারা কর্তৃপক্ষ পুলিশকে না জানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আফরুজুল হক টুটুল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘দাগী ও চিহ্নিত অপরাধীদের জামিনে ছাড়া পাওয়ার বিষয়টি পুলিশকে না জানিয়ে কক্সবাজার কারা কর্তৃপক্ষ নিয়ম লঙ্ঘন করছে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি না থাকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা নতুনভাবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এসব অপরাধীর কারণে কক্সবাজারে সম্প্রতি ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে।’
এএসপি টুটুল নিশ্চিত করেন, সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পাওয়া কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ রুমালিয়ারছড়া এলাকার তালিকাভুক্ত ডজনখানেক মামলার আসামি দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মো. হাসনাতের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের নিয়ম লঙ্ঘনের বিষয়ে কক্সবাজার কারা কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে বলে জানান এএসপি টুটুল।
শুধু এসব অনিয়মই নয়, সদ্য কারামুক্ত শফিউল আলম, আবু তাহের ও রহমত উল্লাহসহ অনেকেই গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, কারাগারে হাজার হাজার টাকার সিট বাণিজ্য চলছে। তারে দাবি— টাকা দিলে সিটে থাকা যায়। আর না দিলে ফ্লোরেও সিট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
এছাড়া স্বজনরা বন্দিদের দেখতে এলে টাকা গুনতে হয় বলে অভিযোগ আছে। জেলা কারাগারের অফিসের জানালা দিয়ে স্বজনরা কথা বলার সুযোগ পান ভিআইপি পাস নিয়ে। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১ হাজার টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে জেল কর্তৃপক্ষ।
সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন