অমিত দাশ গুপ্ত
১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ সদ্য স্বাধীন স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দলকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয়ী করেছিল রাষ্ট্রের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়নের mandate দিয়ে। কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় যুদ্ধের কারণে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের পক্ষে সংবিধান প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত গণপরিষদ জারি করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। সংবিধানের সংজ্ঞা বিশ্নেষণ, প্রণয়ন পদ্ধতি, বৈশিষ্ট্যগত দিক, রাষ্ট্রের নাগরিকদের মেনে নেওয়া কিংবা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সব মিলিয়ে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান যার আলোকে মুজিবনগর সরকার গঠিত ও পরিচালিত হয়েছিল। স্বাধীনতার সংগ্রামকে বেগবান করার তাগিদে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শত্রুর হাতে বন্দি বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি করা হয়। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ প্রজাতন্ত্রের সব নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির। শুধু তাই নয়– প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের নিয়োগ, কর আরোপ ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে অর্পণ করা হয়। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির সব ক্ষমতা প্রয়োগ এবং দায়িত্ব পালন করবেন মর্মে ঘোষণা করা হয়। নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিকারী বাঙালি জনগোষ্ঠী, মুজিবনগর সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র বিনির্মাণের তিনটি উপাদান প্রাপ্ত হয়েছিল; আর ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের মাধ্যমে বিশ্বের মাঝে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
অসম সাহসী বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে কিংবা নির্যাতন করেও পাকিস্তানি জান্তারা ভাঙতে বা মচকাতে পারেনি। ফলে বাধ্য হয়েই তারা বাংলার মুজিবকে বাঙালির কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের একদিনের মধ্যে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ জারি করেন বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান আদেশ। যার মাধ্যমে তিনি সদ্যোজাত রাষ্ট্রের জন্য বেছে নেন মন্ত্রিপরিষদশাসিত শাসন ব্যবস্থা। গঠন করেন পৃথক বিচার বিভাগ। তাঁরই নির্দেশনায় দ্রুততম সময়ে প্রণীত ও গৃহীত হয় আমাদের মূল সংবিধান। সরকার ব্যবস্থায় জবাবদিহি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে, দায়িত্বশীল সরকার গঠনের জন্য মূল সংবিধানেও মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকারের বিধান রাখা হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতি পদ হয়ে ওঠে সম্মানের প্রতীক, আর প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রশাসনের সব পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করি যে, একজন উদারনৈতিক নেতা, যার নামে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল, তাকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক পন্থায় গঠনের ক্ষেত্রে নানারূপ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত পক্ষ দেশের অভ্যন্তরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে; অন্যদিকে স্নায়ুযুদ্ধের বাস্তবতায় বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নবগঠিত রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষে মন্ত্রিপরিষদশাসিত শাসন ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা দুস্কর হয়ে পড়ে। আর তাই সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ২৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সংবিধান (চতুর্থ সংশোধন) আইন পাস করা হয়। যার মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকার পদ্ধতি থেকে বেরিয়ে এসে বঙ্গবন্ধু চালু করেন রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসন ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় দলের বিধান রেখে রাজনৈতিক অধিকারকে সংকুচিত করা হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্ত কতখানি উপযুক্ত কিংবা অনুপযুক্ত ছিল, তা যাচাই করার সুযোগ বাঙালির কাছে আসেনি। কেননা অপশক্তি কতটা ভয়াবহরূপে আবির্ভূত হয়েছিল, তার প্রমাণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত। ওই বেদনাবিধুর অধ্যায়ের ঘানি আজও বাঙালি বহন করে চলেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আবার পাকিস্তানি আদলের সামরিক শাসনের ভূত চেপে বসে। সংবিধানে সামরিক শাসনের কোনো বিধান নেই। কিন্তু সংবিধান (পঞ্চম সংশোধন) আইন, ১৯৭৯ এবং সংবিধান (সপ্তম সংশোধন) আইন, ১৯৮৬–এর মাধ্যমে সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। সামরিক শাসকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি পদকেই বেশি উপযুক্ত মনে করতেন। তাই সামরিক ছায়াতলে রাষ্ট্রপতি পদটি হয়ে ওঠে নির্বাহী প্রধান; পরিণত হয় সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে।
অতঃপর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এ দেশে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে (পরে সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান পঞ্চম সংশোধন এবং সপ্তম সংশোধন আইন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন)। ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ সংবিধান (দ্বাদশ সংশোধন) আইন, ১৯৯১ পাসের মাধ্যমে মন্ত্রিপরিষদশাসিত সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির উর্ধ্বে স্থান লাভ করলেও সরকারের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত হয় প্রধানমন্ত্রী ও তার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদের হাতে। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘এই সংবিধানের ৫৬(৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।‘ ফলে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব ও ক্ষমতা সীমিত। সংবিধানের ৮০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংসদ কর্তৃক প্রণীত বিল আইনে রূপান্তরের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সম্মতির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতির সম্মতির গুরুত্ব সংকুচিত করা হয়েছে। ইংল্যান্ডের মতো আমাদের দেশে রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি বংশানুক্রমিক নয়, বরং জনপ্রতিনিধিদের ভোটে তিনি নির্বাচিত হন। আর নির্বাচনের যোগ্যতা হিসেবে তাকে ৩৫ বছরের বয়স্ক হতে হয় এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা থাকতে হয়। রাষ্ট্রপতির পদের মেয়াদ পাঁচ বছর। তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করতে পারেন। সংবিধান লঙ্ঘন ও গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে এবং শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানের যথাক্রমে ৫২ ও ৫৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অভিশংসন ও অপসারণ করা যায়। রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ পদটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে আলঙ্কারিক পদে পরিণত হয়েছে। সময়ের প্রবহমানতায় মন্ত্রিপরিষদশাসিত শাসন ব্যবস্থায়ও রাষ্ট্রপতি পদের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা যায়। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষায়, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব বৃদ্ধি করার জন্য জনমত গঠন করা যেতে পারে। যে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সেই দেশে রাষ্ট্রপতি পদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধির জন্য দল–মতের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় ঐক্য তৈরি হলে তাতে গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হবে।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।