সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী সংসদ বহাল রেখে অথবা সংসদ ভেঙে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। আইনবিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী হয়তো তার বক্তৃতায় ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ বলতে সংবিধানের এ বিধানকেই বোঝাতে চেয়েছেন। তা ছাড়া এর বাইরে তো সংবিধানে কোনো অপশন (বিকল্প) নেই।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে গণতান্ত্রিক ধারাকে সমুন্নত রাখতে আগামী নির্বাচনে দেশের সব নিবন্ধিত দলকে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের আগে নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে।’ তার এই বক্তব্যের পর আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হবে, তার বিশ্লেষণ শুরু হয় বিভিন্ন মহলে।
জানা যায়, সংবিধানের ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে ‘সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন’-এর ব্যাপারে বলা হয়েছে। এর উপদফা (ক)-তে বলা হয়েছ, ‘মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’ এবং (খ)-তে বলা হয়েছে, ‘মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাংগিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাংগিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে’ নির্বাচন করতে হবে। এতে আরও বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপদফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপদফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।’
আবার সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদে প্রধানমন্ত্রীর পদের মেয়াদ উল্লেখ আছে। এতে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়ার কারণ উল্লেখ করে ৫৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।’
এসব বিধানের কারণে বর্তমান সংবিধানের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন করতে হলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ১২৩-এর দফা ৩-এর উপদফা ‘ক’ অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ অবসানের কারণে নির্বাচন হলে আগামী ডিসেম্বর অথবা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এটা হলে প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভা এবং সংসদ বহাল থাকবে।
তবে উপদফা ‘খ’ অনুযায়ী সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করলে সে ক্ষেত্রে কিছুটা আলোচনার সুযোগ রয়েছে। এই অপশন অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ অবসানের আগে যে কোনো দিন সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন দেওয়া যায়। এই অপশনটা গ্রহণ করলে রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে বর্তমান অবস্থার নিরপেক্ষ সমাধানেরও পথ খোঁজা যেতে পারে। তবে এর ভিত্তিতে সমঝোতা হলে সেই নির্বাচনও হতে হবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব মেনেই। অন্যথায় সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হবে। আর সেটিও যদি না হয়, সংবিধানের বর্তমান অবস্থা মেনে নিয়ে দলীয় সরকারের অধীনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল থাকা অবস্থায় আগামী জাতীয় নির্বাচনে যেতে হবে সব দলকে। এমনটাই মনে করছেন আইনবিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন সরকার বলতে বর্তমান সরকারকেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু ওই সরকার কোন নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেবে না; রুটিন ওয়ার্ক চালিয়ে যাবে আর নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। সংবিধানই বলে দিয়েছে, সরকার নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করবে। নির্বাচনকালীন সরকারও সেই সহযোগিতা করে যাবে। সংসদ ভেঙে নির্বাচন না করলে অন্য দলগুলোর সংশয়, নির্বাচনকালে বহাল থাকা সংসদ নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করবে বা পচ্ছন্দ না হলে বলবে যে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি, এমন প্রশ্নে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, আবার তারাই কি বলতে পারবে যে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয়নি? সবারই গ্রহণ করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে এবং সবাইকেই সেটা গ্রহণ করতে হবে।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট আইনবিশেষজ্ঞ ও নির্বাচন কমিশনের সাবেক আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন করার ক্ষেত্রে ২টি বিকল্প (অপশন) রয়েছে। একটি সংসদ ভেঙে দিয়ে অপরটি সংসদ বহাল রেখে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে নির্বাচনকালীন সরকার বলতে হয়তো নির্বাচনের সময়ে যে সরকার থাকবে, সেটাকেই বোঝাতে চেয়েছেন। অর্থাৎ নির্বাচনের সময় বর্তমান সরকারই তো থাকবে। অন্য কোনো সরকার থাকার বিধান সংবিধানে নেই।
তবে সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করলে সে ক্ষেত্রে আলোচনার সুযোগ রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রস্তাব দিয়েছিল যে, তোমাদের মধ্য (তৎকালীন বিরোধী দল) থেকে দু-চার জন নিয়ে করবে। এটা যে কোনো সময়ই করা সম্ভব। টেকনোক্র্যাট কোটায় মন্ত্রী হিসেবে অন্য দল থেকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সমঝোতার জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার।
উল্লেখ্য, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে (২০১৪) প্রধানমন্ত্রী একটি ছোট আকারের মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ওই মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিএনপিকে, যা বিএনপি সে সময় গ্রহণ করেনি। এখন পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। প্রধানমন্ত্রী শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও বলেছেন, ‘আমরা অতীতকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চাই না; তবে অতীতকে ভুলেও যাব না। অতীতের সফলতা-ব্যর্থতার মূল্যায়ন করে, ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। দল-মত নির্বিশেষে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। এ কারণে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজতে প্রধানমন্ত্রী ভূমিকা রাখবেন বলেও আশা করেন আইনবিশেষজ্ঞরা। সূত্র : আমাদের সময়