প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দেশে নানা ক্ষেত্রে নারীর পদচারণা বাড়ছে। কোনো নির্দিষ্ট কাজের মধ্যে আটকে নেই নারীর পেশা। কৃষিকাজ থেকে শুরু করে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে নারীরা এখন দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। তারা কাজে যোগ্যতার প্রমাণও রাখছেন। পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরা এখন নৌ, বিমান, সেনাবাহিনীতে কাজ করছেন। পুলিশ প্রশাসনে একসময় নারী সদস্যের সংখ্যা খুব কম হলেও সেখানে নারীর উপস্থিতি বেড়েছে। পুলিশে নারীদের অবস্থা, সমাজে নারীদের অগ্রযাত্রার বাঁধা-এসব নিয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন পুলিশ হেডকোয়ার্টাসে কর্মরত ক্রাইম ওয়েস্টের সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (এআইজি) রেবেকা সুলতানা। তার সঙ্গে কথা বলেছেন তাসলিমা তামান্না
পুলিশে নারীরা কতটুকু সফলতা অর্জন করতে পেরেছেন বলে আপনি মনে করেন?
রেবেকা সুলতানা: ১৪ জন সদস্য নিয়ে নারী পুলিশের যাত্রা হয় ১৯৭৪ সালে। আমি পুলিশে যোগ দেই ২০০১ সালে। তখন পুলিশ বাহিনীতে নারী পুলিশের সংখ্যা ছিল প্রায় ২ শতাংশ। বর্তমানে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭ শতাংশের ওপর। ডিআইজি থেকে শুরু করে কনস্টেবল- সব পদেই নারীরা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছেন। নারীদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা আছে। তারপরও আমার মনে হয়, এই সংখ্যা আরও বাড়ানো উচিত। বর্তমানে দেশে নারী পুলিশ সুপার আছেন মাত্র ৩ জন। পুলিশ সুপার পদে যেমন নারীদের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন, তেমনি দরকার অন্যান্য পদেও।
আপনি তো পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ পর্যায়ে আসতে আপনি কী ধরনের বাঁধার সম্মুখীন হয়েছেন? কতটা পারিবারিক সমর্থন পেয়েছেন?
রেবেকা সুলতানা: আমি সেরকম কোনো বাঁধা পাইনি। বরং সমর্থনই পেয়েছি পারিবারিকভাবে, একাডেমিকভাবে। পুলিশে চাকরি করব এরকম কোনো স্বপ্ন আমার ছিল না। তবে ব্যতিক্রমী কোনো পেশায় কাজ করব এরকম একটা ভাবনা কাজ করত। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে পড়াশোনা করেছি। পড়াশোনা শেষে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। যেহেতু আমি আইন বিষয়ে পড়েছি ফরম পূরণের সময় ক্যাডার পছন্দের ক্ষেত্রে আমার মনে হলো, আমাদের দেশে পুলিশে নারীর সংখ্যা কম, এটাকে পেশা হিসেবে নিলে মন্দ হয় না। এ ভাবনা থেকেই বিসিএস ফরম পূরণের সময় পুলিশ ক্যাডারটাকে প্রাধান্য দেই। পুলিশে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি জেনে আমার বাবা-মাও খুশি হন। আমার বাবা ফায়ার সার্ভিসে ছিলেন, আর মা ছিলেন গৃহিণী। তারা কখনোই বলেননি,তুমি মেয়ে, তোমার এই ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় যোগ দেওয়াটা ঠিক হবে না। চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর আমার বিয়ে হয়। সুতরাং আমার স্বামী জানতেন আমার কাজটা কী। আমার স্বামী ব্যবসায়ী। তিনিও কখনও আমার কাজ নিয়ে কোনো ধরনের আপত্তি দেখাননি। বরং তার কাছ থেকেও আমি কাজের ব্যাপারে উৎসাহ পেয়েছি। সন্তান হওয়ার পর কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার বাবা-মা যথেষ্ট সমর্থন দিয়েছেন। বাবা-মা তো বটেই, আমার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা বউ পুলিশ অফিসার-এটা নিয়ে গর্ববোধ করেন।
দেশের প্রধানমন্ত্রী-বিরোধী দলীয় নেতা, স্পিকার নারী। পুলিশ থেকে শুরু করে প্রশাসনের অন্যান্য জায়গায়ও নারীরা আগের তুলনায় এখন বেশি। তারপরও দেশে নারী নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে কেন?
রেবেকা সুলতানা: মানুষের মধ্যে সহিংসতা অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে বিভিন্ন ধরনের নির্মম ঘটনা ঘটছে। মানুষের নৈতিক বোধ কমে যাচ্ছে। শুধু আইন দিয়ে তো সব ধরনের সহিংস ঘটনা কমানো সম্ভব নয়, মানসিকতাও বদলাতে হবে। এ জন্য সমাজ বিশ্লেষকদের সক্রিয় হতে হবে, মিডিয়ার প্রচার, প্রসার বাড়াতে হবে।
আরেকটা বিষয় হলো, আগেও নারীরা ঘরে ঘরে নির্যাতিত হতো কিন্তু বাইরের কেউ তা জানত না। কিংবা নির্যাতিত নারীরা মুখ খুলতেন না। এখন দিন পাল্টেছে। নির্যাতনের শিকার নারীরা প্রতিবাদ করতে শিখেছেন। যারা সহ্য করতে পারছেন না তারা ডিভোর্স করছেন। এটা অনেকেই নেতিবাচকভাবে নিচ্ছেন। বলছেন, নারীরা অধিকার সচেতন হওয়ায় এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। বিষয়টা অন্যভাবেও দেখা যেতে পারে। মানে হলো, নারীরা এখন প্রতিরোধ করতে শিখেছেন। সব কিছু মেনে নিয়ে সংসার চালিয়ে যেতে হবে-এ ধারণা থেকে তারা বের হয়ে আসছেন। নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে তাদের জোরটা বাড়বে, নিজেদের অধিকার সম্পর্কে তারা সচেতন হবেন।
কোনো কোনো ঘটনায় কিন্তু পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে…
রেবেকা সুলতানা: অপরাধীরা যাতে দ্রুত ধরা পড়ে-এ নিয়ে কিন্তু পুলিশ সবসময়ই তৎপর থাকে। অপরাধী দ্রুত ধরা পড়ার কারণে আলোচিত মামলাগুলো দ্রুত বিচারের আওতায় এনে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে। সহিংস ঘটনাগুলো কমানোর জন্য সংশ্লিষ্ট মামলায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
সমাজে নারীর অগ্রযাত্রায় এখনও কী কী ধরনের বাঁধা আছে? কীভাবে তা দূর করা সম্ভব?
রেবেকা সুলতানা: প্রথমেই পরিবার থেকে মেয়ে সন্তানের প্রতি বৈষম্য কমাতে হবে। ছেলে বা মেয়ে সন্তানের মধ্যে পার্থক্য না করে দু’জনকেই সমান দৃষ্টিতে দেখতে হবে। সমান অধিকার দিতে হবে। পরিবারের মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে সে যেন হীনমন্যতায় না ভোগে সেটা পরিবারকেই নিশ্চিত করতে হবে। সুযোগ পেলে মেয়েরাও যে অনেক কিছু করতে পারে-এই বিশ্বাস পরিবারের সদস্যদের মধ্যে থাকাটা জরুরি। পরিবারের পরেই আসে সমাজের কথা। মেয়েদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। এ জন্য ছেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি জরুরি। মা বা বোনের মতো অন্য মেয়েদেরও সম্মান করা উচিত, এই বোধটা তাদের মধ্যে জাগাতে হবে পরিবার থেকেই।
যেসব নারী পুলিশে আসতে চান তাদের উদ্দেশে আপনি কিছু বলুন…
রেবেকা সুলতানা: একজন নারী যদি পুলিশে আসে, তাহলে তার পরিবার যেমন নিরাপদে থাকে, তেমনি তার এলাকার মানুষজনও নিরাপত্তা পায়। অন্য অনেক পেশার চেয়ে এই পেশায় নারীরা বেশি সুরক্ষিত থাকেন। এই পেশায় যেমন চ্যালেঞ্জ আছে; তেমনি আকর্ষণও আছে। যারা কাজের মধ্যে চ্যালেঞ্জ, আকর্ষণ কিংবা ঝুঁকি পছন্দ করেন তারা এই পেশা বেছে নিতে পারেন।
সূত্র – সমকাল