আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ ও মজিবর রহমান খান :
উপজেলা ভূমি কার্যালয়। লোকজনের জটলা। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন মুনসেফ আলী। তিনি খাসজমি বিষয়ে পরামর্শ নেবেন। ঘণ্টা দুয়েক এ-টেবিল ও-টেবিল ঘুরে সন্তোষজনক পরামর্শ পেলেন না। ফিরে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একটি বোর্ড নজরে আসে তাঁর। তাতে লেখা, ‘সেবা পেতে কোনো সমস্যা হলে নিচের বেলটি চাপুন, আপনার এসি ল্যান্ডকে ডাকুন।’ সাহস নিয়ে বেল চাপলেন মুনসেফ। সঙ্গে সঙ্গে এলেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) বা এসি (ল্যান্ড) সোহাগ চন্দ্র সাহা। কক্ষে ডেকে নিলেন মুনসেফকে। পরামর্শ দিলেন।
কার্যালয়ে আসা সেবাপ্রার্থীরা বললেন, ভূমি কার্যালয়ে কাজ মানেই দালালের দৌরাত্ম্য। দিনের পর দিন হয়রানি। কর্মচারীদের অবজ্ঞার পাশাপাশি বাড়তি খরচ। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলা ভূমি কার্যালয়ের চিত্রও একসময় তা-ই ছিল। কিন্তু এখন বদলে গেছে। বদলের পেছনের মানুষটি হলেন সোহাগ চন্দ্র সাহা।
সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, একটা সময় ছিল, কর্মকর্তারা কক্ষে বসে বেল চাপতেন। বাইরে অপেক্ষমাণ সেবাপ্রার্থীরা এক এক করে কক্ষে ঢুকতেন। কর্মকর্তা তাঁর চেয়ারেই বসে থাকতেন। ঢোকার আগে অফিস সহায়কের কাছে অনুমতি নিতে হতো। এই কারণে সেবাপ্রার্থী ও সেবাদানকারীর মধ্যে একটা ফারাক সৃষ্টি হতো। তা দূর করতেই কলবেলের বোর্ড।
সোহাগ চন্দ্র সাহা এই উদ্যোগের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ২০১৫ সালের ১৭ অক্টোবর প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পড়ে। ‘এসি ল্যান্ডের মাটির মায়া’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে রাজশাহীর পবা উপজেলার ভূমি কার্যালয়ের তৎকালীন এসি (ল্যান্ড) শাহাদত হোসেনের প্রায় একই রকম উদ্যোগের কথা ছাপা হয়েছিল। শাহাদত হোসেনের ভাবনার সঙ্গে নিজস্ব কিছু ভাবনা যোগ করার চেষ্টা করেছেন সোহাগ চন্দ্র সাহা।
রানীশংকৈলের অভিজ্ঞতা
সম্প্রতি রানীশংকৈল উপজেলা ভূমি কার্যালয়ে সরেজমিনে দেখা যায়, পরিপাটি করে সাজানো ভূমি কার্যালয়। ভবনের বাইরে টবে নানা প্রজাতির ফুল ও সৌন্দর্যবর্ধক গাছ। কার্যালয়ের মুখেই বোর্ডে নাগরিক সনদ টাঙানো। তাতে জমির নামজারি করতে কত টাকা লাগে, খতিয়ান তুলতে কত, খাসজমি বন্দোবস্ত নিতে করণীয়, কোন বিষয়ে কার সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করতে হবে—এসব তথ্য লেখা। বোর্ডের সামনে ‘সেবা টেবিল’ নামের একটি সহায়ক ডেস্ক। সেখানে একজন কর্মচারী সেবাপ্রার্থীদের তথ্য সহায়তা দেন। পাশের বাক্সে থরে থরে সাজানো নানা আবেদন ফরম। সেখান থেকে সেবাপ্রার্থীরা বিনা খরচে ফরম নিতে পারেন। কর্মচারীদের গলায় ঝুলছে পরিচয়পত্র। প্রতিটি কক্ষে ছোট সাদা বোর্ডে তাঁদের প্রতিদিনের কাজ লেখা। দিন শেষে এসি (ল্যান্ড) সেগুলো ধরে মূল্যায়ন করেন। কার্যালয়ের পেছনে রয়েছে সেবাপ্রার্থীদের বিশ্রামের জায়গা। দূরদূরান্ত থেকে আসা লোকজন সেখানে বিশ্রাম নেন।
মহেশপুর গ্রামের হুমায়ুন কবীর বলেন, গত বছর তিনি জমির নামজারি করার জন্য বহুবার এসেও কাজ সারতে পারেননি। গত ১৩ নভেম্বর তিনি আবারও আসেন। এবার কার্যালয়ের অনেক পরিবর্তন নজরে পড়ে তাঁর। চোখে পড়ে কলবেলের বোর্ড। সেটি চেপে ধরেন তিনি। মুহূর্তেই তাঁর সামনে এসে দাঁড়ান এসি ল্যান্ড। তিনি হুমায়ুনের কথা শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে ডিসিআর (নামজারির পর দেওয়া বিকল্প রসিদ) রসিদ কেটে দিলেন।
গত বছরের ২০ মার্চ সোহাগ চন্দ্র সাহা ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার পদে যোগ দেন। ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি রানীশংকৈলের ভূমি কার্যালয়ে। যোগ দেওয়ার পর দেখেন, কার্যালয়ে দালালের দল। কাজের জন্য কেউ এলেই পড়তেন এঁদের খপ্পরে। বিনা মূল্যের ফরমে ৫০ থেকে ১০০ টাকা আদায় করতেন। এ অবস্থা দেখে সোহাগ চন্দ্র সাহা চালু করলেন ‘কলবেল সেবা’।
সোহাগ চন্দ্র সাহা জানান, এখন কার্যালয়ের সব নথি ক্রমানুসারে সাজিয়ে প্রতিটির সঙ্গে ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। এ কাজ শেষ হলে যেকোনো নথি এক মিনিটের মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া নামজারি ও বিবিধ মামলার শুনানির তারিখ বাদী ও বিবাদীকে মুঠোফোনে খুদে বার্তার (এসএমএস) মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ভূমি কার্যালয় সূত্র জানায়, গত দুই মাসে এক হাজারের বেশি সেবাপ্রার্থীকে প্রতিকার ও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এ সময় বিবিধ মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১০০টি। নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে আরও ২৫টি মামলা।
কার্যালয়ের চেইনম্যান নূরুল হুদা বলেন, আগে কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট না হলে সেবাপ্রার্থীরা এসি ল্যান্ডের কাছে যেতেন। এখন তাঁরা সরাসরি এসি ল্যান্ডের কাছে যান।
সোহাগ চন্দ্র সাহা জানালেন, তাঁর বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রামে। অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে থেকেই তাঁর বেড়ে ওঠা। বিভিন্ন দপ্তরে কাজে গিয়ে এলাকার গরিব-দুঃখী মানুষের হয়রানি হওয়া দেখেছেন। ভূমি কার্যালয়ে গিয়ে বিভিন্ন সময় তাঁর বাবাকেও হয়রানির শিকার হতে দেখেছেন তিনি। সোহাগ চন্দ্র সাহা প্রশাসন ক্যাডারে যোগদানের পর বাবা ডেকে বলেছিলেন, ‘মানুষকে সেবাটা দিয়ো।’ এটাই তাঁকে অনুপ্রেরণা দেয়।
জেলা প্রশাসক মো. আবদুল আওয়াল গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সব উপজেলায় এ মডেল চালুর উদ্যোগ নেবেন।
‘মাটির মায়া’ থেকে শুরু
২০১৫ সালে রাজশাহীর পবা উপজেলা ভূমি আফিসের জনবান্ধব সেবা চালু করেছিলেন তৎকালীন সহকারী কমিশনার শাহাদত হোসেন। নিজের অফিসের নিচে একটি টিনের ছোট ঘর তৈরি করেছিলেন তিনি। সকালে এসে সেখানেই বসতেন, গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলতেন সরাসরি। তিনি এই ঘরের নাম দিয়েছিলেন ‘মাটির মায়া’। সমস্যা শুনে যেটার তাৎক্ষণিক সমাধান সম্ভব সেটা করে দিতেন। আর অন্যদের হাতে চিকিৎসকের মতো তুলে দিতেন একটি করে চিরকুট। তাতে তাঁর সঙ্গে পরবর্তী সাক্ষাতের তারিখ লেখা থাকত। নির্ধারিত দিনে সেবাগ্রহীতা গিয়ে সেবা পেয়ে যেতেন।
২০১৫ সালে প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় এ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হলে সব ভূমি অফিসে এই উদ্যোগ চালুর বিশেষ উদ্যোগ নেন তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার হেলালুদ্দীন আহমেদ। সেই উদ্যোগ কতটা সফলভাবে চলছে, তা জানতে দৈবচয়ন ভিত্তিতে পাঁচটি উপজেলার ভূমি অফিসগুলো সম্প্রতি ঘুরে দেখা হয়।
পাঁচ উপজেলার অভিজ্ঞতা
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সার্টিফিকেট পেশকার মকবুল হোসেন নামজারি ও বিবিধ মামলার নোটিশ বোর্ড আপডেট করছেন। হেল্প ডেস্কে বসে গেছেন মাবিয়া খাতুন। এসি (ল্যান্ড) শিমুল আকতার তাকাচ্ছেন পাশের ‘রাজস্ব আদালতের’ দিকে, কোনো সেবাগ্রহীতা এসেছেন কি না।
ঈশ্বরদীর ‘রাজস্ব আদালত’-এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাটির ময়না’। সেদিন নামজারির কাজে এসেছিলেন মহাদেবপুর গ্রামের আকাল সরদার। তৎক্ষণাৎ বললেন, তিনি তাঁর সেবা পেয়ে খুশি।
এসি (ল্যান্ড) জাহিদ হাসান সিদ্দিকী পুঠিয়া উপজেলার ভূমি অফিসে যোগদান করার পর গত ১৯ অক্টোবর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে যেকোনো সেবার জন্য সরাসরি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার আহ্বান জানান। গত ২২ অক্টোবর পুঠিয়া ভূমি অফিসে গিয়ে দেখা যায়, এসি (ল্যান্ড) নেই। কয়েকজন মানুষ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি রাজশাহীতে একটি সভায় আছেন। ফিরে এসে তাঁদের কাজ করে দেবেন। এই প্রতিবেদক ফোন নম্বর দিয়ে আসেন। কাজ না হলে ফোন করে জানাতে বলেন। উপজেলার তেবাড়িয়া গ্রামের রবিউল ইসলাম, বালাদিয়াড় গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও বিড়ালদহ গ্রামের আবদুর রহিম পরে ফোন করে জানান, সহকারী কমিশনার এসেই তাঁদের কাজ করে দিয়েছেন।
রাজশাহীর দুর্গাপুর ভূমি অফিসে গিয়ে সেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভূমি অফিস থেকে দালাল দূর করতে গিয়ে তাঁদের এখন নিজের কাজ নিজেকেই করতে হচ্ছে। বাজুখলসি গ্রামের বাবলু বলেন, সব কাগজপত্র দেখে নিয়ম অনুযায়ী কাজ করতে হচ্ছে। এটা ভালো, তবে সব কাগজপত্র গোছাতে একটু সময় লাগছে। একই কথা বলেন শালবাড়িয়া গ্রামের সালাউদ্দিন। তবে তাঁরা বলেন, এখন দালালকে কোনো পয়সা দিতে হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সহকারী কমিশনার সমর পাল প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অল্প দিন আগে এখানে যোগ দিয়েছেন। যাঁর কাজ তিনি তাঁকেই আসতে বলছেন, অন্য কারও হাত দিয়ে আসা মানেই সেখানে দালাল ঢুকে পড়তে পারে।
যে পবা ভূমি অফিস থেকে এই কার্যক্রম শুরু, সেখানে প্রায় চার মাস ধরে কোনো সহকারী কমিশনার নেই। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আলমগীর কবির দায়িত্বে রয়েছেন। কয়েকজন সেবাগ্রহীতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজ হচ্ছে। তবে আগের মতো একজন এসি (ল্যান্ড) দরকার।
তবে বাঘা উপজেলার অভিজ্ঞতা একটু ভিন্ন। গত ৫ অক্টোবর সেখানকার ভূমি অফিসে গিয়ে দেখা যায়, হেল্প ডেস্কে ধুলা জমে রয়েছে। সহকারী কমিশনার জুবায়ের হোসেনকে তাঁর কার্যালয়ে পাওয়া যায়। জনবান্ধব সেবা কার্যক্রম চালু আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি অনেকক্ষণ বিষয়টি বুঝতেই পারছিলেন না। একপর্যায়ে বলেন, ব্যস্ত আছেন, পরে কথা বলবেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সেবাগ্রহীতা বলেন, এই অফিসে আবার দালাল ভিড়ে গেছে। দালাল ছাড়া কোনো কাজ হচ্ছে না। টাকাও লাগছে বেশি। সূত্র: প্রথম আলো