ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে যেখানে-সেখানে সাজা দেওয়ার ঘটনায় ক্ষোভ জানিয়েছে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘এটা কোন ধরনের খেলা চলছে?’
ফৌজদারি মামলায় পুলিশ হেফাজতে থাকা ব্যক্তিকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়ার ঘটনায় দায়ের করা এক রিট শুনানিকালে আজ রোববার (২৮ জানুয়ারি) বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের সমন্বয়ে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
আদালত বলেন, ‘পুলিশ হেফাজতে থাকা ব্যাক্তিকে সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট কিভাবে অন্ধ থাকেন? পুলিশ থাকতে পারে, তা না হয় বুঝলাম! কিন্তু ১৩ তারিখে (গত ১৩ অক্টোবর) আটক করে তারপর জেলখানায় নিয়ে পরদিন (১৪ অক্টোবর) ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হয় কী করে?’
এরপর তলব করা লোহাগাড়ার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, থানার ওসি ও দুই এসআইয়ের পক্ষের আইনজীবী ফারজানা শারমিন ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাজার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। সেই শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বলেন, ‘অন্য (যেকোনও) মামলায় গ্রেফতার করলে নিয়ে যাবেন আদালতে। তা না নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাজা দিলেন?’
এ সময় মনজিল মোরসেদ লোহাগাড়ার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে ইঙ্গিত করে আদালতকে বলেন, ‘ওনাদের মতো ব্যক্তিদের কারণে সাধারণ মানুষ ভ্রাম্যমাণ আদালতের ওপর আস্থা হারিয়েছে। এ কারণেই বিষয়টি আদালত পর্যন্ত এসেছে। তাই ওই কর্মকর্তাকে ম্যাজিস্ট্রেসি না দেওয়ার আবেদন করছি এবং ওসি দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়েও এমন ঘটনা ঘটায় তাকে প্রত্যাহারের আবেদন করছি।’
এরপর আদালত আইনজীবী ফারজানা শারমিনের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা কি এ বিষয়ে কনটেস্ট (প্রতিদ্বন্দিতা) করবেন?’ উত্তরে আইনজীবী বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা কনটেস্ট করব।’
আইনজীবীর এই উত্তরে আদালত ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘যেখানে তাদের অপরাধ স্পষ্ট, সেখানে কী করে আপনারা কনটেস্ট করতে চান?’
এ সময় আইনজীবী ফারজানা শারমিন আদালতের কাছে কয়েকবার দুঃখপ্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি দুঃখিত। আমরা ক্ষমা চাচ্ছি। কনটেস্ট করতে চাই না।’ তখন আদালত বলেন, ‘ফাইজলামির একটা লিমিট (সীমা) আছে। এমনিতেই যা মনে চায়, করেন। যেখানে দেখছেন, এটা কালপেবল রং (দণ্ডনীয় ভুল), সেখানে আপনারা কনটেস্ট করতে চাচ্ছেন?’
আদালত আরও বলেন, ‘১৩ তারিখে (গত ১৩ অক্টোবর) তাকে আটক করা হয়েছে। ১৪ তারিখে (পরদিন ১৪ অক্টোবর) তাকে আদালতে হাজির করতে হবে। কিন্তু কেন সেখানে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসবে? এটা কোন ধরনের খেলা চলছে? উকিলসহ জরিমানা করা দরকার। এ ধরনের প্র্যাকটিস (আদালতে মামলা পরিচালনা) করবেন না। (আইনজীবী সনদ বাতিলের বিষয়ে) সরাসরি বার কাউন্সিলে পাঠিয়ে দেবো।’
এরপর আদালত এ বিষয়ে দুপুরে আদেশের সময় নির্ধারণ করেন। কিন্তু আইনজীবী মনজিল মোরসেদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদেশের জন্য আগামীকাল সোমবার দিন ধার্য করেন হাইকোর্ট।
এর আগে গত ১৪ জানুয়ারি এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে লোহাগাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আলম, ওসি মো. শাহজাহান, এসআই হেলাল খান ও ওয়াসিমকে তলব করেন হাইকোর্ট। অভিযোগ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানাতে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) চারজন তলবে আজ হাইকোর্টে হাজির হয়েছিলেন।
সাজানো ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়া হয়েছে—এমন দাবি করে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ও ক্ষতিপূরণ চেয়ে মোহাম্মদ বেলাল উদ্দীন ওই রিটটি করেন। এই বেলালকে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়া হয়েছিল।
জানা গেছে, গত ১৩ অক্টোবর রাত নয়টায় বেলালকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন একটি ফৌজদারি মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। পুলিশের এক জব্দ তালিকায় দেখা যায় ১৩ অক্টোবর রাত নয়টায় তাঁর কাছ থেকে দুই পুরিয়া গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর ইউএনও পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত ১৪ অক্টোবর দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে দুই পুরিয়া গাঁজা উদ্ধারের ঘটনায় বেলালকে আট মাসের জেল দেন।
পরে সাজানো ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়ায় এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন ভুক্তভুগি বেলাল।
রিটের শুনানি নিয়ে আদালত রুল জারি করেন। রুলে হাইকোর্ট ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজা সাজানো বলে কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না এবং যাঁরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন।
একইসঙ্গে রিট আবেদনকারীকে ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্রসচিব, লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ পাঁচ বিবাদীর কাছে। ওই পাঁচজনকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
সুপ্রিমকোর্ট প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম