আজ ২৮ জানুয়ারি ২০১৮, রোববার। ১৯৮২ সালের এই দিনে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন উদ্বোধন করা হয়। এটি পৃথিবীর দৃষ্টিনন্দন আইনসভা ভবনের একটি। প্রখ্যাত মার্কিন স্থপতি লুই আই কান এর মূল স্থপতি।
রাজধানী ঢাকার শের-ই-বাংলা নগরে অবস্থিত এ ভবন এলাকার আয়তন ২১৫ একর। মূল ভবনের পাশাপাশি রয়েছে উন্মুক্ত সবুজ পরিসর, মনোরম জলাধার ও সংসদ সদস্যদের কার্যালয়। ১৯৬১ সালে সংসদ ভবনের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ইতিহাসের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১৯৮২ সালের ২৮ জানুয়ারি এ ভবনের উদ্বোধন করা হয়।
ইতিহাস
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যতগুলো সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তারমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় নির্বাচনের পর গঠিত সংসদের অধিবেশনগুলি অনুষ্ঠিত হয় পুরনো সংসদ ভবনে, যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) জন্য আইনসভার জন্য জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। ১৯৮২ সালের ২৮শে জানুয়ারি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর একই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদের অষ্টম (এবং শেষ) অধিবেশনে প্রথম সংসদ ভবন ব্যবহৃত হয়। তখন থেকেই আইন প্রণয়ন এবং সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনার মূল কেন্দ্র হিসাবে এই ভবন ব্যবহার হয়ে আসছে।
সংসদীয় ইতিহাস
বাংলাদেশে গঠিত সকল সংসদের তালিকা:
১) প্রথম সংসদ: ২ বছর ৬ মাস (৭ই এপ্রিল, ১৯৭৩ – ৬ই নভেম্বর, ১৯৭৫) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে
২) দ্বিতীয় সংসদ: ২ বছর ১১ মাস (২রা এপ্রিল, ১৯৭৯ – ২৪শে মার্চ, ১৯৮২) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে
৩) তৃতীয় সংসদ: ১ বছর ৫ মাস (১০ই জুলাই, ১৯৮৬ – ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৮৭) জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে
৪) চতুর্থ সংসদ: ২ বছর ৭ মাস (১৫ই এপ্রিল, ১৯৮৮ – ৬ই ডিসেম্বর, ১৯৯০) জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে
৫) পঞ্চম সংসদ: ৪ বছর ৮ মাস (৫ই এপ্রিল, ১৯৯১ – ২৪শে নভেম্বর, ১৯৯৫) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে
৬) ষষ্ঠ সংসদ: ১২ দিন (১৯শে মার্চ, ১৯৯৬ – ৩০শে মার্চ, ১৯৯৬) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বে
৭) সপ্তম সংসদ: ৫ বছর (১৪ই জুলাই, ১৯৯৬ – ১৩ই জুলাই, ২০০১) আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে
৮) অষ্টম সংসদ: (২৮শে অক্টোবর, ২০০১ – ২৭শে অক্টোবর, ২০০৬) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোটের নেতৃত্বে
৯) নবম সংসদ: (২৫ জানুয়ারী, ২০০৯ – ২৪ জানুয়ারী, ২০১৪) আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট
১০) দশম সংসদ: (২৫ জানুয়ারী, ২০১৪- )
এর মধ্যে প্রথম সংসদ কখনোই জাতীয় সংসদ ভবন ব্যবহার করেনি। প্রতিটি সংসদের নেতা ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
স্থাপত্যশৈলী ও নকশা
লুই কান কমপ্লেক্সের অবশিষ্ট অংশের ডিজাইন করেন। জাতীয় সংসদ ভবন জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সের একটি অংশ। কমপ্লেক্সের মধ্যে আরো আছে সুদৃশ্য বাগান, কৃত্রিম হ্রদ এবং সংসদ সদস্যদের আবাসস্থল।
অবস্থান
ঢাকার শের-এ-বাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সকে ঘিরে রয়েছে চারটি প্রধান সড়ক: উত্তর দিকে লেক রোড; পূর্ব দিকে রোকেয়া সরণী; দক্ষিণ দিকে মানিক মিয়া এভিনিউ এবং পশ্চিম দিকে মিরপুর রোড। ফলে সংসদ অধিবেশন চলাকালে যানবাহন চলাচল ও সহজে চলাচল নিয়ন্ত্রন করা সম্ভবপর হয়। মূল ভবনটি (সংসদ ভবন) মূলতঃ তিন ভাগে বিভক্ত:
মেইন প্লাজা : ৮২৩,০০০ বর্গফুট (৭৬,০০০ বর্গমিটার)
সাউথ প্লাজা : ২২৩,০০০ বর্গফুট (২১,০০০ বর্গমিটার)
প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা : ৬৫,০০০ বর্গফুট (৬,০০০ বর্গমিটার)
মূল ভবনটি কমপ্লেক্সের কেন্দ্রে অবস্থিত। এমপি হোস্টেল এবং জরুরী কাজে ব্যবহৃত ভবনসমূহ কমপ্লেক্সের বহির্ভাগে অবস্থিত। মূল ভবন ঘিরে অবস্থিত কৃত্রিম হ্রদ, দুটি বাগান এর মাঝের শূণ্যস্থান পূরণ করেছে।
স্থাপত্য দর্শন
এই স্থাপনার স্থাপত্য দর্শনের মূলে ছিল স্থানের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং স্থাপত্যশৈলীর মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে স্থাপত্যশৈলী দ্বারা।এটি পৃথিবীর অন্যতম শিল্পকলাগুলোর মধ্যে একটি।
মূল ভবনের নকশা
মূল ভবনটি নয়টি পৃথক ব্লক দিয়ে তৈরী: মাঝের অষ্টভূজ ব্লকটির উচ্চতা ১৫৫ ফুট এবং বাকি আটটি ব্লকের উচ্চতা ১১০ ফুট। প্রতিটি ব্লকের জায়গাকে বিভিন্ন কাজের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে, করিডোর, লিফট, সিড়ি ও বৃত্তাকার পথ দিয়ে আনুভূমিক ও উলম্বিকভাবে ব্লকগুলোর মাঝে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। পুরো ভবনটির নকশা এমনভাবে প্রনয়ন করা হয়েছে যাতে সব ব্লকগুলোর সমন্বয়ে একটি ব্লকের অভিন্ন স্থান হিসাবে ব্যবহার করা যায়।
দ্বিতীয় তলার একটি লাগোয়া ব্লকে প্রধান কমিটির রুমগুলো রয়েছে। সকল ধরনের সংসদীয় কার্যক্রম, মন্ত্রী, চেয়ারপারসন এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির অফিস রয়েছে এই ভবনে। একই ভবনে সংসদীয় সচিবের জন্যও কিছু অফিস বরাদ্দ রয়েছে।
মেইন প্লাজার মূল অংশটি হচ্ছে সংসদ অধিবেশন কক্ষ। এখানে একই সময়ে ৩৫৪ জন সদস্যের সংস্থান রাখা হয়েছে। ভিআইপিদের জন্য দুইটি পোডিয়াম এবং দুইটি গ্যালারী রয়েছে। পরাবৃত্তাকার ছাদসম্পন্ন অধিবেশন কক্ষটির উচ্চতা ১১৭ ফুট। ছাদটি স্বচ্ছভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে দিনের আলো এতে প্রবেশ করতে পারে। সূর্যের আলো চারদিকের ঘেরা দেয়াল ও অষ্টভূজকৃতির ড্রামে প্রতিফলিত হয়ে অধিবেশন কক্ষ প্রবেশ করে। (আলোর নান্দনিকতা ও সর্বোচ্চ ব্যবহার লুই কানের স্থাপত্য ক্ষমতার নিদর্শনস্বরূপ।)
কৃত্রিম আলোকে এমনভাবে বিভক্ত করা হয়েছে যে সূর্যের আলোর প্রবেশের ক্ষেত্রে তা কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। শ্যান্ডেলির বা ঝাড়বাতিগুলো পরাবৃত্তাকার ছাদ হতে নিচে নেমে এসেছে। এর গঠনশৈলীতে ধাতুর ব্যবহার প্রতিটি আলোক উৎসর ভিত্তি হিসাবে কাজ করে।
উপরের অংশের অভ্যাগত এবং গণমাধ্যমের জন্য গ্যালারীর ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও এর বিভিন্ন অংশে রয়েছে: প্রথম তলায়, একটি গ্রন্থাগার; তৃতীয় তলায়, সংসদ সদস্যদের জন্য লাউঞ্জ এবং উপর তলায়, মিলনায়তন।
সাউথ প্লাজা
দক্ষিণ দিকে মানিক মিয়া এভিনিউর অভিমুখে সংসদ ভবনের সাউথ প্লাজা অবস্থিত। এর ক্রমোচ্চ (Gradually rises) ২০’ উচ্চতার ভবন কাঠামো সৌনর্য বর্ধনের পাশপাশি সংসদ ভবনের মূল প্রবেশ পথ (অধিবেশন চলাকালে) হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
এখানে আরো রয়েছে: নিয়ন্ত্রিত প্রবেশপথ; ড্রাইভওয়ে; প্রধান যন্ত্রপ্রকৌশল কক্ষ; গাড়ি পার্কিং-এর জন্য বিস্তৃত পরিসর; টেলিফোন এক্সচেঞ্জ; রক্ষনাবেক্ষণ কাজে নিয়োজিত প্রকৌশলীদের অফিসকক্ষ; উপকরণ সরঞ্জাম রাখার স্থান; এবং মূল ভবনে যাওয়ার জন্য উম্মুক্ত চত্বর।
প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা
উত্তর দিকে অবস্থিত প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা সম্মুখে লেক রোড অবস্থিত। এই প্লাজা সংসদ সদস্য এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মার্বেলের তৈরি মেঝে, গ্যালারী এবং খোলা পথ এই প্লাজার নির্মাণশৈলীর বৈশিষ্ট্য।
নির্মাণকার্য সূচনা: ১৯৬১
নকশা ও নির্মাণ ব্যয়: ১২৯ কোটি টাকা
উদ্বোধন: ২৮শে জানুয়ারি, ১৯৮২
স্থপতি: লুইস কান
মোট এলাকা: ২০০ একর (৮,০০,০০০ বর্গমিটার)
অবস্থান: শেরে-বাংলা নগর, ঢাকা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভা। দেশের সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা এ সংসদের ওপর ন্যস্ত। প্রতি নির্বাচনী এলাকা থেকে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত ৩০০ সদস্য সমন্বয়ে জাতীয় সংসদ গঠিত।
জাতীয় সংসদের মেয়াদ ৫ বছর। এ মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর স্বাভাবিক নিয়মে সংসদ বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি বিশেষ পরিস্থিতিতে যে কোনো সময় সংসদ ভেঙে দিতে পারেন। দেশে যুদ্ধ দেখা দিলে সংসদের মেয়াদ অনধিক এক বছর বর্ধিত করা যেতে পারে। তবে যুদ্ধ সমাপ্ত হলে এ বর্ধিত মেয়াদ ছয় মাসের বেশি হতে পারে না। যুদ্ধাবস্থায় কিংবা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বে জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি পুনরায় সংসদের অধিবেশন আহবান করতে পারেন। তবে রাষ্ট্রপতির এ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে হতে হবে। তথ্যসূত্র : ইউকিপিডিয়া
ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম ডেস্ক