তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে বিতর্ক চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ওই আইনের ধারার অপপ্রয়োগে সাংবাদিকসহ নানা পেশার মানুষ ক্রমাগত হয়রানির শিকার হতে থাকলে ধারাটি বাতিলের দাবি ওঠে। অবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সেই ৫৭ ধারা বাতিল করে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮’ এর খসড়া অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
নতুন আইন পাস হলে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বিলুপ্ত হবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম।
বাতিলের অপেক্ষায় থাকা তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় রয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে বিদ্যমান আইনে।
৫৭ ধারা বাতিল হলে ওইসব কঠোর সাজা থাকবে না বলে মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় ২৫, ২৮, ২৯ এবং ৩১ ধারায় ওই অপরাধের বিষয়গুলো ভাগ করে রাখা হয়েছে। অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্তির বিধান ও জামিনযোগ্য-জামিন অযোগ্য বেশ কিছু ধারা রাখা হচ্ছে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে।
প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ঘুরে ফিরে সেই ৫৭ ধারাই আবার আসতে পারে। রাষ্ট্রের, জনগণের নিরাপত্তা, জঙ্গি তৎরপতা দমনের জন্যে আধুনিক প্রযুক্তিগত নিরাপত্তাসহ যেকোন আইন অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু আইনের দোহাই দিয়ে মুক্তচিন্তা ও অবাধ তথ্য প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো অংশে দুর্নীতি ও পেশীশক্তির প্রদর্শন হতে পারে বলে শঙ্কা হচ্ছে। নতুন এই আইনের উপযোগিতা এবং প্রয়োগ কীভাবে হয়, তা দেখতে কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে।
তবে নতুন আইনে সর্বনিম্ন সাত বছরের শাস্তির বিধান তুলে দেওয়া হয়েছে এবং অপরাধের মাত্রা ও ধরন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তির সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে নতুন আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিষয় উল্লেখ রয়েছে।
নতুন আইন অনুযায়ী ডিজিটাল মাধ্যমে প্রকাশিত বা প্রচারিত কোনো তথ্য-উপাত্ত দেশের সংহতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ বা জনশৃঙ্খলা ক্ষুণ্ণ করলে বা জাতিগত বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টি করলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তা ব্লক বা অপসারণের জন্য টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে অনুরোধ করতে পারবে। খসড়া আইনে সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় কম্পিউটার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে।
৫৭ ধারা বিলুপ্ত হলেও নতুন আইনটির ৩২ ধারা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ ধারায় ডিজিটাল অপরাধের বদলে গুপ্তচরবৃত্তির সাজার বিধান রাখা হয়েছে। ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তি অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে ১৪ বছর কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
এ ধারার সংযোজনে অনুসন্ধানী এবং বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাও গুরুতর আপরাধ হিসেবে চিহ্নিত হবে। এর ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ভীষণভাবে কমে যাবে। অন্যদিকে সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা এবং বেআইনি কাজের সুযোগ প্রসারিত হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
গত কয়েক বছরে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের বিরুদ্ধে নানা সময়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ধর্মীয় অনুভূতির সংজ্ঞা কী হবে- প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেন, পেনাল কোডে ধর্মীয় অনুভূতির যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সেটা এখানে প্রযোজ্য হবে।
সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের হওয়া ৭৪০টি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ মামলা রয়েছে ৫৭ ধারায়। ২০১৩ সালে প্রথম তিনটি মামলা হওয়ার পর প্রতি বছর মামলার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ সালে সারাদেশে ৩৩টি মামলা হলেও ২০১৫ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫২তে। ২০১৬ সালে ৫৭ ধারায় মামলা হয় ২৩৩টি, আর ২০১৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এই ধারায় মামলা হয়েছে ৩২৩টি।
নিজস্ব প্রতিনিধি/ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম