উচ্চ আদালতে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত মামলা জট নিরসন, আপীল বিভাগে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে মামলা নিষ্পত্তি ও বিচারপতি সঙ্কট দূর করতে শীঘ্র সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ করা হচ্ছে। বর্তমান আপীল বিভাগ ও হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনসহ মোট ৮৪ বিচারপতি রয়েছেন। এর মধ্যে হাইকোর্টে ৮০ জন এবং আপীল বিভাগে ৪ জন। এর আগে আপীল বিভাগে ১১ জন বিচারপতি দায়িত্ব পালন করেছেন। ইতোমধ্যে আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগ থেকে বেশ কয়েকজন বিচারপতি অবসরে গেছেন। চলতি বছরসহ আগামী বছরে আরও কয়েকজন বিচারপতি অবসরে যাবেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, উচ্চ আদালতের হাইকোর্ট বিভাগে ১২ থেকে ১৬ জন এমনকি ২০ জনও হতে পারে । একই সঙ্গে আপীল বিভাগে ৪ থেকে ৬ জন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে। উভয় বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হলে মামলার জট অনেকাংশে কমে যাবে বলে জানা গেছে।
আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, শীঘ্র উভয় বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে। তবে কত জন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে তা বলা যাবে না।
এর আগে এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন , আমি মনে করি, আপীল বিভাগ তার কাজের যে ভার সেটার জন্য যে সংখ্যক বিচারপতি প্রয়োজন সেই দিকটা বিবেচনা করে আপীল বিভাগে সেই রকমভাবে বিচারপতি নিয়োগ করা হবে। কতদিনের মধ্যে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়া চলতে থাকবে ।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ গণমাধ্যমকে বলেন, আপীল বিভাগ ও হাইকোর্টে শীঘ্রই বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে। আপীল বিভাগের চার জন বিচারপতি থাকার কারণে ট্রাইব্যুনালের মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আপীল বিভাগের মাত্র একটি বেঞ্চ রয়েছে। সেখানে প্রধান বিচারপতিসহ চার বিচারপতি কাজ করছেন। শীঘ্র আপীল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ করা হবে, তখন এ বেঞ্চ বাড়াবে এবং মামলার শুনানি হবে। তবে আমি আশা করি শীঘ্র আপীল বিভাগে বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক বলেছেন, আপীল বিভাগের প্রায় ২১টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। দুই বছর যাবত আপীল বিভাগের কোন মামলার শুনানি হচ্ছে না। এখানে ভিক্টিম, বিচারপ্রার্থী, অভিযোগকারীসহ আসামিদের বয়স হয়েছে। আসামিদের যদি ন্যাচারাল ডেথ হয়ে যায় সে ক্ষেত্রে বিচারটার যুক্তিটা থাকে না। এই আইনের স্পিরিটটা হলো দ্রুত বিচার করা। শুনছি উচ্চ আদালত বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। আপীল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হলে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাসহ অন্য মামলাতেও গতি ফিরে আসবে।
এদিকে সুপ্রীমকোর্টের আইনবিদগণ মনে করেন, মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে হলে বিচারককে পাশাপাশি আইনজীবীদেরও ধ্যান-ধারণা পাল্টাতে হবে। তা না হলে যতই বিধি পরিবর্তন করা হোক না কেন কোন সুফল বয়ে আসবে না। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আরও বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। তা হলো মধ্যস্থতাকারী নিয়োগ এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি এডিআর এর ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক।
এ প্রসঙ্গে সুপ্রীমকোর্টের একাধিক সিনিয়র আইনজীবী বলেছেন, মামলা অনুপাতে বিচারপতি না থাকায় মামলা জটের অন্যতম কারণ। উপযুক্ত ও দক্ষতাসম্পন্ন বিচারপতির অভাব, বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার কম থাকায় মামলা জটের কারণ। সমস্যা উত্তরণে অধিক সংখ্যক উপযুক্ত সততা ও দক্ষতাসম্পন্ন বিচারক নিয়োগ দিতে হবে। বিচার ব্যবস্থার কার্যক্রমে পরিবর্তন আনতে হবে। ব্রিটিশ আমলে যেভাবে রায় লেখা হতো এখনও সেই আঙ্গিকে রায় লেখা হচ্ছে। জনসংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে মামলা দায়েরের সংখ্যাও। এজন্য বিচারপতি ও প্রয়োজনীয় জনবল বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে মেধা, দক্ষতা, সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে।
এদিকে সুপ্রীমকোর্ট বার সমিতির সভাপতি এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক নিয়োগ দলীয় বিবেচনায় হলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। তারা সংবিধানের ৯৫(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারক নিয়োগে নীতিমালা প্রণয়নের দাবিও জানান। এদিন জয়নুল আবেদীন বলেন, আমরা শুনতে পাচ্ছি সরকার সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের পাঁয়তারা করছে। আমরা বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত সুপ্রীমকোর্টে বিচারক নিয়োগের নীতিমালা বা নিয়োগের ব্যাপারে সুপ্রীমকোর্টের রায়ের নির্দেশনা সম্পর্কে কিছুই বলে নি।
সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ১০ জনকে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে ২ বছরের জন্য নিয়োগ দেয়। তাদের মধ্যে গত ডিসেম্বরে একজন মারা যান। আর একজনকে বাদ দিয়ে বাকি ৮ জনকে স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেয়া হয়। বর্তমানে স্থায়ী নিয়োগ না পাওয়া দুই বিচারপতির রিট আবেদন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে আপীল বিভাগে। ২০১৫ সালের পর গত আড়াই বছরেও উচ্চ আদালতে আর কাউকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়নি। যদিও ২০১৬ সালের আগস্টে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে সেপ্টেম্বরে প্রধান বিচারপতির কার্যালয় থেকে হাইকোর্টে নিয়োগের জন্য কয়েক জনের নাম প্রস্তাব করে সুপারিশ পাঠানো হয়। জনকণ্ঠ