কারাগারে বন্দি থাকার পরও তৎপরতা বন্ধ নেই জঙ্গিদের। কারাগারে বসেই বিভিন্নভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। যেসব জঙ্গিকে কারাগারে নেওয়া হচ্ছে, তারা সেখানে অন্যদেরও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিভিন্ন পর্যায়ের ৫৭৭ জন জঙ্গি এখন কারাগারে বন্দি আছে বলে জানিয়েছেন কারা কর্তৃপক্ষ। জঙ্গিরা যাতে সেখানে তৎপরতা চালাতে না পারে সেজন্য কারাগারে তাদের শ্রেণিবিন্যাস করে আলাদা রাখার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করেন পুলিশ সদর দফতরের এমন একজন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে— তাদের কাছে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে, বিভিন্ন ঘটনা ও মামলায় গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিরা কারাগারে গিয়েও তাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও কারা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে অবহিত করা হয়েছে। কারা কর্তৃপক্ষ সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বলেও পুলিশকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।
কারাগারের ভেতরে জঙ্গিরা যাতে কোনও তৎপরতা চালাতে না পারে সেদিকে নজর রাখার জন্য গত ২০ মার্চ কারা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কারা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), আনসার আল ইসলাম, হিযবুত তাহরির, হিযবুত তাওহীদ ও হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশসহ (হুজিবি) বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের পাঁচ শতাধিক জঙ্গি কারাগারে বন্দি আছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কারা অধিদফতরের মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন বলেন, ‘কারাগারে বর্তমানে বিভিন্ন পর্যায়ের ৫৭৭ জন জঙ্গি বন্দি আছে। সংগঠন ভিত্তিক বন্দি জঙ্গিদের ক্লাসিফাইড করার চেষ্টা চলছে। একইসঙ্গে বেশি রেডিকালাইজড জঙ্গিদের কাছ থেকে তুলনামূলক কম রেডিকালাইজডদের আলাদা করার কাজও এগিয়ে নিচ্ছি আমরা।’
এই আইজি প্রিজন্সের ভাষ্য, ‘জঙ্গিবাদ থেকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় (ডিরেডিকালাইজেশন) আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। জঙ্গিরা একটা আদর্শে বিশ্বাস করে। সেখান থেকে তাদের সরিয়ে নিতে আমাদের আরও বেশি জানতে হবে। ইতোমধ্যে আমাদের ২০ জন কর্মকর্তাকে আমেরিকান দূতাবাসের সহায়তায় ডিরেডিকেলাইজেশন বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারি একটি সংস্থার তত্ত্বাবধানে আরও ২০ জন কারা কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেগুলো প্রয়োগ করতে সময় লাগবে।’
পুলিশ সদর দফতর ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজানসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিবিরোধী ১৬টি বড় অভিযান পরিচালনা করে পুলিশ।
এর মধ্যে হলি আর্টিজানে ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ড’, কল্যাণপুরে ‘অপারেশন স্টর্ম ২৬’, রূপনগরে ‘অপারেশন রূপনগর’, আজিমপুরে ‘অপারেশন আজিমপুর’, মোহাম্মদপুরে ‘মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ’, নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় ‘অপারেশন হিট স্ট্রং ২৭’, গাজীপুরে ‘অপারেশন গাজীপুর’, মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে ‘অপারেশন হিট ব্যাক’ ও বড়হাটে ‘অপারেশন ম্যাক্সিমাস’, কুমিল্লার কোর্টবাড়িতে ‘অপারেশন স্ট্রাইক আউট’, ঝিনাইদহের পোড়ামাটিতে ‘অপারেশন সাউথ প’, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে ‘অপারেশন ঈগলহাট’, ঝিনাইদহের মহেশপুরে ‘অপারেশন শাটল স্পিড’, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ‘অপারেশন অ্যাসল্ট ১৬’ ও রাজশাহীর গোদাগাড়িতে ‘অপারেশন সান ডেভিল’ পরিচালনা করা হয়। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এসব অভিযানে ৫৯ জন শীর্ষ জঙ্গি মারা যায়। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকসহ গুলি ও অস্ত্র।
এছাড়া ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন ও পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খান হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় জেএমবি, নব্য জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৩০ শীর্ষ জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। তারাও বর্তমানে কারাগারে আছে।
জঙ্গিদের তৎপরতা প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমানের বিশ্বাস, বড় ধরনের নাশকতা ঘটানোর মতো সক্ষমতা এখন আর জঙ্গিদের নেই। তার ভাষ্য, ‘সব ধরনের জঙ্গি তৎপরতা প্রতিরোধে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। এছাড়া কারাগারে থাকা জঙ্গিদের ওপর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি কারা কর্তৃপক্ষের নজরদারি রয়েছে। সত্যি বলতে কারাগারে পুলিশের করণীয় কিছু নেই।’
পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহা-পুলিশ পরিদর্শক (এআইজি) সহেলী ফেরদৌস গণমাধ্যমকে বলেন, ‘জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পুলিশের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত জঙ্গিবাদের অভিযোগে ৯২০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে বিচারাধীন রয়েছে ৬১৯টি। আর তদন্ত চলছে ৩০১টির। বিভিন্ন কারণে ২১ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। বিভিন্ন সময় এসব মামলায় ৩ হাজার ৬৭৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’ বাংলা ট্রিবিউন