মোহাম্মদ মনির উদ্দিন
সাইবার অপরাধ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস, কম্পিউটার, স্মার্টফোন ইত্যাদি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংঘটিত হয়। এই অপরাধে কমবেশি সব দেশই প্রতিনিয়ত আক্রান্ত তথা হামলার শিকার হচ্ছে। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ দেবারতি হালদার ও কে জয়শংকর সাইবার অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, ‘আধুনিক টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক, যেমন ইন্টারনেট (চ্যাট রুম, ই-মেইল, নোটিশ বোর্ড ও গ্র“প) এবং মোবাইল ফোন (এসএমএস/এমএমএস) ব্যবহার করে, অপরাধমূলক অভিপ্রায়ে কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে সম্মানহানি, কিংবা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে শারীরিক বা মানসিক ক্ষতি বা ক্ষতির কারণ হওয়া’। এ ধরনের অপরাধ যেকোন রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে হুমকির কারণ হতে পারে। বৈশ্বিকভাবে রাষ্ট্রীয় বা ব্যক্তি সত্ত্বা কর্তৃক গুপ্তচরবৃত্তি, আর্থিক প্রতারণা, সীমান্ত অপরাধসহ নানা রকমের সাইবার অপরাধ অহরহ সংঘটিত হচ্ছে। ফলে এই অপরাধ দমন ও অপরাধীকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার জন্যে যুগোপযোগী আইন অতি জরুরী।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনগত বৈধতা ও নিরাপত্তা প্রদান এবং আনুষাঙ্গিক বিষয়াদি বিধান প্রণয়নকল্পে বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ (একই সনের উনচল্লিশ নম্বর আইন) প্রণীত হয়। এই আইনে নয়টি অধ্যায় এবং নব্বইটি ধারা বিদ্যমান রয়েছে। আইনটি প্রনীত হওয়ার সাথে সাথেই ৫৭ ধারা নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় ওঠে। যে কারণে ২০০৬ সালের আইন ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে দুইবার সংশোধন করা হয়। এতদ্সত্ত্বেও এই আইনের অসঙ্গতি দূর হয়নি। ফলশ্রুতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর ৫৪, ৫৫, ৫৬ এবং ৫৭ ধারা বাতিল করে সাইবার অপরাধ দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ২৯-০১-২০১৮ তারিখে মন্ত্রিপরিষদ সভায় আইনটির খসড়া অনুমোদিত হয়। খসড়া আইনটি বিল আকারে মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে। প্রস্তাবিত আইনটি পাশ হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর শেষে এটি আইন হিসেবে কার্যকর হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ তে মোট ৪৮টি ধারার মধ্যে ০১ থেকে ১৬ ধারায় ডিজিটালের সংজ্ঞা, ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব, ইমার্জেন্সি রেসপন্সটিম গঠন এবং ১১ সদস্যের একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। এই আইনে ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪ ধারাসমূহ আমলযোগ্য ও জামিনযোগ্য এবং আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে আপসযোগ্য, অপরাধের বিচার ও দন্ডের বিষয়ে ১৭-৪৮ ধারায় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে।
বহুল আলোচিত ৫৭ ধারাসহ উল্লিখিত পাঁচটি ধারা বাতিল করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ তে ৪৮টি ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিধান উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য বহুল আলোচিত ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্টানে কেউ যদি বেআইনীভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যে কোনো ধরনের ইলেকট্রানিক্স যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচর বৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে সেই ব্যক্তি ১৪ বছরের কারাদন্ড ও ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।’ এই আইনের ২৮ ধারায় রয়েছে, ‘কেউ যদি ধর্মীয়বোধ ও অনুভূতিতে আঘাত করে, তাহলে তার ১০ বছরের জেল ও ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা হবে। ২৯ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কেউ মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে সেই ব্যক্তির ৩ বছরের জেল ও ৫লক্ষ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ যদি চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়, তাহলে সেটা একটি গণবিরোধী ও সংবিধান পরিপন্থি আইন হিসেবে আবির্ভূত হবে। আইনের অপপ্রয়োগের মাধ্যমে ভয়াবহভাবে নিপিড়নের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে। এই আইনের ফলে মানুষের অধিকার খর্ব করার প্রচেষ্টা, বাক স্বাধীনতা দমনের ব্যবস্থাসহ অপরাপর যেসব প্রভাব পড়বে তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:-
০১।ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানুষের নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হবে ০২। এই আইনের ফলে দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার হবে ০৩। শাসকদের হাতে নিপিড়নের শক্তিশালী অস্ত্র তুলে দেওয়া হবে ০৪।আমলাদের ক্ষমতা অপ্রয়োগের দাপট বহুগুন বেড়ে যাবে ০৫।সরকারের কোনো অপছন্দের মানুষকে অতি সহজে আটক করা যাবে ০৬। কারো কাছ থেকে কোনো তথ্য সংগ্রহ করা যাবে না ০৭। ঘুষ-দুর্নীতির মাত্রা সর্বত্র প্রসারিত হবে ০৮। ঘুষ-দুর্নীতি সহনশীল হয়ে অধিকতর প্রতিযোগিতা হবে ০৯। গণমাধ্যম পঙ্গু হয়ে যাবে ১০। সাংবাদিকদের হাত-পা বেঁধে দেওয়া হবে ১১। সাংবাদিককে অতি সহজেই গুপ্তচর হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে ১২। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করা যাবে না ১৩।আমলাদের দুর্নীতি-ঘুষ বাণিজ্যের খবর প্রকাশ করা যাবে না ১৪ লেখক, ব্লগার, সিটিজেন সাংবাদিকতার গলা টিপে ধরা হবে ১৫। ঘুষ গ্রহণের ছবি ও তথ্য প্রকাশ করা যাবে না ১৬। গোপনীয়তার সংস্কৃতি চর্চা বৃদ্ধি হবে ১৬।বই লেখার জন্যে একরকম এবং অনলাইনে লেখার জন্যে আরেকরকম শাস্তি হবে ১৭।দুর্নীতিবাজ-শাসক, আমলাদের দুর্নীতি ও ঘুষগ্রহণ অবাধে করতে পারবে ১৮। অসাধুদের প্রভাব ও অপতৎপরতা ক্রমাগত বেড়ে যাবে।
এইসব বিষয় ও আরও নানা ধরনের-রকমের হয়রানী, দমন-পীড়ন, প্রতিবন্ধকতা, ভয়-ভীতি ইত্যাদি জনমনে প্রবল আকারে দেখা দেবে। খসড়া এই আইন মন্ত্রীসভা অনুমোদন করার কারণে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। অনেকের আশঙ্কা ও সমালোচনার অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো-
আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক- ‘৩২ ধারার মাধ্যমে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, অনুসন্ধানী রিপোর্টটা বন্ধ হয়ে যাবে। অনুসন্ধানী রিপোর্টটি গণতন্ত্রের জন্যে সরকারের জবাবদিহিতার জন্যে সবচেয়ে প্রয়োজনীয়। এটা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মানে সংবাদ মাধ্যমে তার প্রধান কাজটা করা থেকে বিরত থাকবে এবং যাদের বা যেসব প্রতিষ্ঠানের কথা বলা হচ্ছে, তারা জবাবদিহিতার উর্ধ্বে উঠে যাবে। দেশ, সমাজ, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন কোনটার জন্যেই এধরনের বিধান বাঞ্চনীয় নয়।’ ‘রাষ্ট্রের গোপনীয় তথ্য সিল ছাপ্পর দিয়ে গোপনীয় রাখা হয়। সংবাদ মাধ্যমের লোকজন রাষ্ট্রের কোনো গোপনীয় তথ্য অনুসন্ধানী রিপোর্টে প্রকাশ করেনা। যেগুলো রাষ্ট্রের গোপনীয় সেগুলো প্রকাশে যদি বাঁধা দেওয়া হয় এবং অনুসন্ধানী রিপোর্ট বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে মিডিয়া রেখে লাভ কী? খসড়ায় এটা তো পার্থক্য করেনি যে, কোনটি গোপনীয় বা গোপনীয় নয়।’
টিআইবি’র ইফতেখারুজ্জামান-‘এই আইনের ফলে তথ্য প্রকাশের অধিকার খর্ব হবার পাশাপাশি দুর্নীতির বিস্তার ঘটবে।’ ‘এই আইনের ফলে দুর্নীতির যেমন বিস্তার ঘটবে পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘন, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ সংক্রান্ত যে সমস্ত তথ্যাবলী মানুষের জানার কথা বা জানার অধিকার রয়েছে; এমন কি প্রকাশের অধিকার রয়েছে সাংবাদিকসহ অন্যান্য গণমাধ্যম কর্মীদের তা খর্ব হবে।’
মানবাধিকার কর্মী নূর খান- ‘নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আগের ৫৭ ধারাকে ও ছাড়িয়ে গেছে। ওই আইন বাতিল করে এবার যা করা হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হবে, সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বাঁধাগ্রস্থ হবে এবং সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ আরও কঠিন হয়ে পড়বে।’
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া- ‘৫৭ ধারা যেভাবে ছিল, নতুন আইনটিতে সেটিই প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বিধি-বিধান আগে যেভাবে ছিল তার চেয়ে বরং কঠিন কঠিন বিধি বিধান যুক্ত হয়েছে। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে শাস্তির পরিমাণ কমেছে; কিন্তু বাস্তবিক অর্থে বেড়েছে।’ ‘আমরা যা প্রস্তুাব করেছি তারা রাখা হয়নি বলেই মনে হচ্ছে। এ পর্যন্ত যা জানা গেছে তাতে নতুন ডিজিটাল আইনে বিতর্কিত তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নতুন আইনের ১৮ এবং ১৯ ধারায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ৩২ ধারায় যে বিধান রাখা হয়েছে তাতে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এবং স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হবে।’
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান- ‘এ আইনটি আগের আইসিটি এ্যাক্ট এর চেয়েও নিবর্তনমূলক করা হয়েছে। এ আইনে বিশেষ করে সাংবাদিক, লেখক ও মুক্তবুদ্ধির মানুষেরা নিগৃহীত হবার আশঙ্কা আরো বেড়ে গেছে। সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট বন্ধ করতেই এ আইন।’
বিশিষ্ট সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার- ‘এর ফলে স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে যা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পরিবর্তন করে ৫৭ ধারার বিকল্প হিসেবে চারটি ধারা আনা হয়েছে। সেগুলো কিন্তু স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে কিছুটা অন্তরায়।’ ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যেভাবে সাংবাদিকরা কাজ করে সে পথটিতেই কিন্তু অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়েছে। এটাকে গুপ্তচরবৃত্তি বলে সেই অপরাধে অপরাধী করা হচ্ছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এটুকুই করতেই হয়। এটা সারা দুনিয়াতেই আছে।’
সিপিজে- ‘প্রস্তাবিত আইনে যে ভাষা ব্যবহার করা হেেছ তারা নির্দোষ সমালোচনাও সাইবার ক্রাইম হিসেবে ধরে নেওয়ার সুযোগ তৈরী করেছে।’
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম- ‘কালো আইনের বদলে কুচকুচে কালো আইন জাতিকে উপহার দিচ্ছে। এ আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার সব গণআন্দোলনের ইতিহাস এবং স্বৈরাচারী আন্দোলনের শহীদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার পদক্ষেপ নিয়েছে।’
রাজনীতিবিদ খন্দকার মোশারফ হোসেন- ‘বাকশালী কায়দায় অতীতে যেভাবে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছিল, আজও এ আইনের মাধ্যমে তা করা হচ্ছে। কারণ সরকার অলিখিতভাবে বাকশালের পথেই হাঁটছে। মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় চেয়েও ভয়ঙ্কর।’
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ- ‘গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাদের মান ইজ্জত থাকেনা। তাদের সম্মান ক্ষুন্ন হয়। তারা তো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ চিন্তা ভাবনা করেই করা হয়েছে। আগের আইসিটি এ্যাক্টটি বিএনপির সময়ে করা ছিল। যেখানে অনেক বিষয় অস্পষ্ট ছিল। নতুন আইনে বিষয়গুলো আরও স্পষ্ট করা হয়েছে। গণমাধ্যমে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট বন্ধ করতে এ আইন করা হলেও আমার বিশ্বাস আপনাদের ঠেকানো যাবে না।’
রাজনীতিবিদ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল- ‘শুধু বোতল পাল্টানো হয়েছে। মানে নতুন বোতলে পুরোনো মদ।’
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারÑ ‘অতীতে আমরা নানা ধরনের কালা কানুন দেখেছি। কিন্তু এই আইনটি শুধু কালা কানুন না। এই আইন কার্যকর করলে মধ্যযুগের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো পার্থক্য থাকবে না। সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথ রুদ্ধ করে দেয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে গণমাধ্যমেরও টুটি চেপে ধারা হচ্ছে। কোনো সভ্য সমাজে এই আইন সম্ভব না। কোনো অপরাধীর অপরাধ নিয়ে লেখা যাবেনা। এই খারাপ আইনের ব্যবহার ভালো হবে কিভাবে?’
সাংবাদিক শ্যামল দত্ত- ‘এটা ভিন্ন নামে একই জিনিস’
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ২০০৬ কার্যকর হওয়ার পর দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় উঠে। বিশেষ করে বিতর্কিত ৫৭ ধারাসহ অপরাপর কয়েকটি ধারার অপরাধ বিলপ্ত করা হলেও এ ধারার অপরাধ ২৫, ২৮, ২৯, ৩১ ধারায় ভাগ করে বিন্যাস্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ ৫৭ ধারার অপরাধ ৪টি ধারায় কৌশলে ভাগ করে বন্টিত হয়েছে। আইসিটি আইন, ২০০৬ এর ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে। ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক্স বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে আইন শৃঙ্খলার অবনতি হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসাকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন ৭ বছর কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদন্ড দেওয়ার বিধান আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ খসড়ায় ২৫, ২৮, ২৯ এবং ৩১ ধারায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ এর ৫৭ ধারার অপরাধগুলো ভাগ করে রাখা হয়েছে। এসব ধারায় মানহানি, মিথ্যা ও অশ্লীল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং শত্র“তা সৃষ্টি ও আইন শৃঙ্খলার অবনতি সংক্রান্ত অপরাধগুলো রয়েছে। এতে অপরাধের ধরণ অনুযায়ী শাস্তির মাত্রাগত কিছুটা তারতম্য হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ কার্যকর হলে ‘কালোর চেয়েও কুচকুচে কালো’ আইন হিসেবে গণধিকৃত হবে। এই আইন পাশ হলে জনসাধারণের বাক স্বাধীনতা হরণ করার সামিল হবে। মত প্রকাশের ক্ষেত্রে হয়রানির প্রবল আশঙ্কায় স্বাধীন সাংবাদিকতা বাঁধাগ্রস্থ হবে। মুক্তচিন্তার অন্তরায় এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মোক্ষম এক হাতিয়ার হিসেবে দেখা দেবে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও গবেষণা কার্যক্রমের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। সাংবাদিক ও মুক্তচিন্তার মানুষের হাত-পা বাঁধার জন্য একটি আইনই যথেষ্ট। এই আইন পাশ হওয়া জনস্বার্থ বিরোধী হবে। প্রস্তাবিত এই আইন রাষ্ট্র ও জাতীকে গভীর সঙ্কটের মুখে নিপতিত করবে। আইনের অপপ্রয়োগ করে একশ্রেণীর স্বার্থান্বেষী দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, অন্যায়কারী, হীন বা কায়েমী স্বার্থে সুযোগ ও সুবিধা নেবে। মন্ত্রী, এমপি, আমলাদের দুর্নীতির খবর ছাপানোর মতো সাহস কোন সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের থাকবেনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সমালোচনা করা যাবে না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। মত প্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের সাংবিধানিক অধিকার। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে কেড়ে নেওয়া হবে এ আইনের মাধ্যমে। নাগরিকদের বাক স্বাধীনতায় বাঁধা দেওয়া মানে গণতন্ত্র চর্চায় আঘাত করা; যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। কালো আইন কোনভাবেই মানুষের মঙ্গল করতে পারেনা; বরং যারা এই আইন পাশ করে তারাই গণবিমুখ ও গণধিকৃত হিসেবে ইতিহাস স্থান পায়। সাময়িক সুবিধার জন্যে এই আইন করা হলেও চূড়ান্ত বিবেচনায় আত্মঘাতি হবে। ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা খসড়া আইনকে সংশ্লিষ্টজন গনমাধ্যমসহ আইনবিশেষজ্ঞদের সাথে আলাপ-আলোচনাক্রমে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সংশোধন করে গণমুখী আইন পাস করতে হবে।
লেখক: আইনজীবী