ব্যারিস্টার গাজী ফারহাদ রেজা (সজীব)
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যারিস্টার ডিগ্রি ধারীদের বেপারে বেশ কিছু লেখা আমার নজরে এসেছে যেখানে অনেকেই বলেছেন এই ডিগ্রি তাদের কোন কাজে আসে নাই, বা বাংলাদেশে এই ডিগ্রির প্রয়োজনীয়তাই নাই! ব্যয়বহুল ব্যারিস্টার ডিগ্রি নেওয়া থেকে বিদেশ থেকে কোন বিষয়ে এল.এল.এম করা কেই সেই লেখা গুলাতে প্রয়োজনীয় মনে করা হয়েছে। আমার এই লেখার মাধ্যমে আমি আমার ব্যারিস্টার হওয়ার সুবিধা অসুবিধা বলব যা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত, কাউকে ছোট করা বা তাদের কথার বিরোধিতা করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি ২০১০ এ এল. এল. বি. শেষ করি London Metropolitan University থেকে। তারপর দেশে এসে practice শুরু করি ২০১১ তে। ২০১৩ তে আমি ইংল্যান্ড এর Northumbria University, UK তে এল. এল. এম. শেষ করে ২০১৪ তে বার-এট-ল ডিগ্রিতে ভর্তি হই এবং ২০১৫ সালে Linclon’s Inn এ কল পাই। যেহেতু আমি ইংল্যান্ড থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন এর উপর এল. এল. এম. করেছি, সেই সাথে ব্যারিস্টার ডিগ্রিও অর্জন করেছি তাই আমি মনে করি আমি উপরোক্ত বিষয়ে সামগ্রিক আলোচনা করতে পারব যা এই বিষয়ে জানার আগ্রহী যে কারও জন্য সহায়ক হবে।
এই আলোচনার পূর্বে প্রথমত, আমাদের জানা উচিত আসলে আইনজীবী, লইয়ার বা উকিল বলতে আমরা কি বুঝি? আইনজীবী হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আইনের উপর এল এল বি ডিগ্রি নিয়েছেন এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিল এর আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষায় পাস করেছেন। এই পরীক্ষায় বসার পূর্বে যেকোনো শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে একজন সিনিয়র যার ১০ বৎসরের ওকালতির অভিজ্ঞতা আছে উনার কাছে ৬ মাসের অভিজ্ঞতা দেখাতে হবে। যদি বার কাউন্সিল এর এক্সাম এর আগে এই ৬ মাসের অভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে কেউ বার কাউন্সিল এর আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষায় বসতে পারবেন না। সুবিধার কথা হল একজন ব্যারিস্টার এর জন্য এই ৬ মাসের আভিজ্ঞতা প্রযোজ্য নয়। তিনি সরাসরি বার কাউন্সিল পরীক্ষায় বসতে পারবেন। এটা একটা সুবিধা, তাই নয় কি?
দ্বিতীয়ত, আমাদের জানা উচিত একজন আইনজীবী বা উকিলের কাজটা আসলে কি? এইটা কিন্তু একটা মজার বিষয়। টিভি নাটকে, মুভিতে আমরা দেখি একজন আইনজীবী কোর্ট এ আর্গুমেন্ট করেন, তার বিপক্ষকে যুক্তি দিয়ে ঘায়েল করেন বা সত্য কথা বের করে নিয়ে আসেন যা আদালতকে প্রকৃত সমস্যার সমাধান করতে সাহায্য করে। অনেকে হয়ত জানেন না যে এই আর্গুমেন্ট করার বা সাক্ষীকে প্রশ্ন করার আইনগত নিয়ম কানুন আছে। একজন আইনজীবী কিন্তু যা ইচ্ছা তাই আইনগত ভাবে কোর্ট এ বলতে পারেন না। কোর্ট এ নিজের সাক্ষী পরীক্ষা করার মেথড হল Examination-in-Chief এবং প্রতিপক্ষের সাক্ষী পরীক্ষা করার মেথড হল Cross-Examination। প্রথমে মামলার বাদীর Examination-in-Chief হয়, এরপর তার Cross-Examination হয়। একজন আইনজীবীর কাজ হল নিজের সাক্ষীর কাছ থেকে সরাসরি কোন প্রশ্ন না করে, যে উত্তর আশা করছেন তার কোন হিন্ট দিয়ে (leading question) তার কাছ থেকে মামলার ঘটনাটা বের করে কোর্টের সামনে তুলে ধরা। কিন্তু অপর পক্ষের আইনজীবীর কিন্তু এই leading question এর ব্যাপারে কোন বাদ্ধবাধকতা থাকে না। যেমন ধরা যাক, একটি চুরির মামলায় বাদী পক্ষের আইনজীবী তার মক্কেলকে সরাসরি প্রশ্ন করতে পারবেন না যে , অমুক কি চুরি করেছে? অমুক কি বিকাল ৫টার সময় আপনের বাসায় ছিল? অমুক কি আপনের লকার ভেঙ্গে টাকা চুরি করেছে? এই একই প্রশ্ন সরাসরি না করে একজন আইনজীবী করতে পারেন এইভাবে, যেমন, আপনি কি এই মামলার বাদী? আপনি কেন এই মামলাটা করেছেন? সাক্ষী মামলা কেন করেছেন প্রশ্ন করলে যদি সব ইনফর্মেশন, [যেমন , কে চুরি করেছে? কখন চুরি করেছে? কেউ দেখেছিল কিনা? কি চুরি হয়েছে? ইত্যাদি] না দেয় তাহলে তাকে আরও প্রশ্ন করা যেতে পারে তবে সেই প্রশ্নের ভিতর উত্তরের হিন্ট থাকলে হবে না। যেমন এই প্রশ্ন করা যাবে যে আপনের বাসায় কখন চুরি হয়েছে? কিন্তু করা যাবে না, আপনের বাসায় কি বিকাল ৫ টায় চুরি হয়েছে? এইরকম। বোঝাই যায় ব্যাপারটা মজার কিন্তু একই সাথে অনেক কঠিন। তো বিষয় টা তো শেখার বিষয়, জানার বিষয় কিন্তু দুঃখ জনক হলেও সত্য লইয়ার হওয়ার যে ডিগ্রি (এল. এল. বি. ) এখানে এই প্রায়োগিক (practical) ব্যাপার গুলার প্রয়োগের এবং প্রায়োগিক শিক্ষার সুযোগ কম। সেটা একমাত্র কোর্ট এ রেগুলার practice ছাড়া শেখা খুব কষ্টকর। এই কথা কিন্তু ইংল্যান্ডের জন্যও প্রযোজ্য। এই জন্য সেখানে এল. এল. বি. এর পর প্রায়োগিক ডিগ্রি নেওয়া লাগে যে ডিগ্রি নেওয়ার পরে একজন আইনজীবী হিসেবে কোন law firm বা লইয়ারের জুনিয়র হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান। বার-এট-ল ডিগ্রিটা এমন একটা প্রায়োগিক ডিগ্রি যেখানে কিভাবে জেরা করতে হয়, কিভাবে মক্কেল এর সাথে কথা বলতে হয়, কিভাবে কোর্ট এর সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হয়, কিভাবে আইনগত মতামত লিখতে হয় ইত্যাদি মোট ১২ টি প্রায়োগিক বিষয়ের উপর প্রায় ১ বৎসরের একটা প্রশিক্ষণ হয় এইটা এল. এল. বি. থেকে আলাদা। বর্তমানে বাংলাদেশে এই ধরনের কোন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে বলে আমার জানা নাই। অনেক আগে বার কাউন্সিল এই ধরনের ব্যবস্থা করত যা এখন অনেকদিন ধরে বন্ধ আছে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি একজন আইনজীবী হিসেবে বলতে পারি আমি বার-এট-ল ডিগ্রি করে অনেক উপকৃত হয়েছি এবং আমার বাংলাদেশের practice লাইফে এই ডিগ্রির অনেক অবদান।
তৃতীয়ত, বর্তমান আইনজীবীদের কাজ কিন্তু শুধু কোর্টে সীমাবদ্ধ না। মক্কেল অনেক সময় কোন মামলা করার আগে তার মামলার Merit জানতে চায়। তখন research করে আইনগত মতামত দেওয়ার প্রয়োজন হয় যে কাজটি অনেক আইনজীবী কোর্টে না এসেও করে থাকেন। ব্যারিস্টার ডিগ্রিতে একটা সাবজেক্ট আছে “opinion writing” যেখানে আমাদের শেখানো হয় কিভাবে আইনগত মতামত দিতে হবে, কিভাবে লিখতে হবে, কিভাবে মতামত দেওয়ার আগে গবেষণা করতে হবে, সেই গবেষণার ফল কিভাবে লেখার মাধ্যমে দিতে হবে সেটা নাকি আবার এমন ভাবে দিতে হবে যেন পরবর্তীতে যদি বিষয়টি মামলাতে গড়ায় তখন যেন কাজে আসে। এইটা নিঃসন্দেহে কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ একটা ব্যাপার কিন্তু সঠিক প্রশিক্ষণ পেলে এক্ষেত্রে সময় বাঁচানো যায়। একজন আইনজীবীর যদি এই আভিজ্ঞতা না থাকে তাহলে প্রায়োগিক ভাবে শিখতে গেলে বহুবছর লেগে যেতে পারে। এই প্রশিক্ষণ বার-এট-ল ডিগ্রিতে শেখানো হয়, যা আমি মনে করি একজন আইনজীবীর কাছে অনেক মূল্যবান একটা শিক্ষা।
চতুর্থত, ব্যারিস্টার ডিগ্রিতে আমি শিখেছি কিভাবে কার্যকরী ভাবে কোর্টের সামনে মামলা উপস্থাপন করতে হবে। এই ডিগ্রিতে একজন আইনজীবীকে দেওয়ানি (সিভিল) এবং ফৌজদারি (ক্রিমিনাল) উভয় বিষয়ের advocacy skill এর প্রায়োগিক শিক্ষা দেওয়া হয়। কিভাবে কোর্টকে সহযোগিতা করতে হয় আবার একই সাথে নিজের মক্কেল এর পক্ষে মামলা জিতার জন্য পরিচালনা করতে হয়। এটা একটা আর্ট। কোর্টে শুনানি করা একদিকে যেমন অনেক কঠিন আবার সহজ; সঠিক প্রায়োগিক শিক্ষা অথবা বহুবছর নিয়মিত কোর্ট practice থাকলেই একজন আইনজীবী এই বিষয়ে পারদর্শী হন। বার-এট-ল ডিগ্রিতে আমাদের শেখানো হয় মামলা উপস্থাপনের কার্যকরী উপায়। যেমন কোর্টে মামলা উপস্থাপনের জন্য যদি মামলার মূল বিষয় এক পৃষ্ঠার ভিতরে লিখে কোর্টকে দেওয়া হয় তাহলে সেটি কোর্টের অনেক মূল্যবান সময় বাঁচে এবং মাননীয় বিচারকদের মামলার বিষয় বুঝতে সুবিধা হয়। এইটা কিন্তু গুড practice, করতেই হবে এমন কোন কথা নাই! কিন্তু অবশ্যই এই practice সবাই করলে সামগ্রিক ভাবে সবাই লাভবান হয় তাই আমার কাছে বার-এট-ল ডিগ্রির এই শিক্ষাটি অনেক মূল্যবান। আমি এই প্রসঙ্গে একটি প্রাসঙ্গিক কথা বলে রাখি যে এইটা সত্য বাংলাদেশের এবং ইংল্যান্ডের বর্তমান আইনের ধারা আলাদা, আইন আলাদা কিন্তু একটি সিভিল বা ক্রিমিনাল মোকদ্দমার ইংল্যান্ডের advocacy standard শিখলে কিন্তু বাংলাদেশেও তার প্রয়োগ সম্ভব। তাই আমি এই ধারনার সমর্থক নই যে ইংল্যান্ডের আইন আলাদা বলে বার-এট-ল ডিগ্রি করে কোন লাভ নাই। আমি বরং মনে করি আমার advocacy standard development এ বার-এট-ল ডিগ্রির প্রায়োগিক শিক্ষা বিরাট ভূমিকা রাখছে যে কারণে আমাকে কেউ যখন জিজ্ঞাসা করে আমি সিভিল নাকি ক্রিমিনাল practice করি আমি বলতে পারি আমি দুইটাতেই সমান পারদর্শী। তবে এক্ষেত্রে একটু বলে রাখা ভাল advocacy standard শিক্ষা গ্রহণ করা আর আইন জানা কিন্তু একটি অন্যটির পরিপূরক। এই আইন কিভাবে কার্যকরী ভাবে খোজা বা জানা যায় সেই জানার উপায়ও কিন্তু বার-এট-ল ডিগ্রির প্রায়োগিক শিক্ষার অন্তর্গত।
পঞ্চমত, আগেই বলেছি এইটা সত্য যে ইংল্যান্ডের আইনের ধারা আর বাংলাদেশের আইনের ধারার অনেক পার্থক্য আছে যদিও বাংলাদেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আইন যেমন: সাক্ষ্য আইন, দেওয়ানী ও ফৌজদারি আইন, ইংল্যান্ডের পুরাতন আইন কাঠামোর সাথে অনেকখানি সামঞ্জস্যপূর্ণ। তদুপরি বর্তমান আধুনিক ইংল্যান্ডের আইন নিয়ে পড়লে তা অবশ্যই বাংলাদেশের আইন পেশায় সাহায্য করে। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায় আগে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় মারা গেলেও কোন ক্ষতিপূরণের আইনগত ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু ইংল্যান্ডে এই বিষয়ে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ব্যবস্থা আছে, কিভাবে এই ক্ষতির হিসাব করতে হবে তার চার্ট আছে, শরীরের কোন অঙ্গ হারালে কত ক্ষতিপূরণ, মারা গেলে তার পরিবার কি পাবে, চাকরি হারালে তার কি ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি। আমি বার-এট-ল ডিগ্রিতে এই বিষয়ের প্রায়োগিক শিক্ষা পাই যা পরবর্তীতে কাজে আসে আমার বাংলাদেশের practice এ। অনেকেই হয়ত জানবেন মাটির ময়না চলচিত্রের পরিচালক তারেক মাসুদ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান তখন তার স্ত্রী কোর্টে মামলা করেন। এর এই মামলা পরিচালনা করেন Dr. কামাল হোসেন এর নেতৃত্বে Dr Kamal Hossain & Associates এর বিজ্ঞ আইনজীবীগণ। এই ক্ষতিপূরণ মামলায় আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল যেখানে আমি দেখেছি আমার ইংল্যান্ডের ক্ষতিপূরণ আইনের শিক্ষা পুরোপুরি কাজে দিয়েছে এবং কোর্টের কাছে আমরা যে ক্ষতিপূরণের হিসাব দিয়েছিলাম সেই ক্ষতিপূরণের হিসাবে ইংল্যান্ডের হিসাব নিরূপণের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। এছাড়া বার-এট-ল ডিগ্রিতে আমাদের বিরোধ নিষ্পত্তি আইনের একটি সাবজেক্ট ছিল যেখানে আমরা কিভাবে কোর্টের বাইরে মামলার নিষ্পত্তি করা যায় তার অনেক প্রায়োগিক শিক্ষা পাই যা আমি মনে করি যদি আমরা আইনজীবীরা বাংলাদেশে অনুসরণ করি তাহলে আমরাই মামলার শিকল থেকে সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের মুক্ত হতে সাহায্য করতে পারি সর্বোপরি কোর্টের মামলা জট কমাতে সাহায্য করতে পারি। তাই এই কথা বলতে পারি যে ইংল্যান্ডের আইন নিয়ে পড়লে তা অবশীয় বাংলাদেশের আইন পেশায় সাহায্য করে। পুরাপুরি না হলেও আইনের প্রায়োগিক দিকের শিক্ষা পাওয়া যায় যা একজন আইনজীবী হিসেবে practice এ সাহায্য করে।
ষষ্ঠত, এইবার আসি এল এল এম করবেন নাকি বার-এট-ল ডিগ্রি করে টাকা নষ্ট করবেন? যেহেতু আমি দুইটা ডিগ্রিই করেছি তাই বলি আমার জানা মতে ইংল্যান্ডে একটি এল. এল. এম. করতে যে খরচ হয় বার-এট-ল ডিগ্রি করতে প্রায় একই পরিমাণ টাকা লাগে। দুইটাই যেহেতু post-graduate qualification তাই tuition fee প্রায় একই। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, দুইটা ডিগ্রি দুইধরনের শিক্ষা দেয়। এল. এল. এম. করে আপনি একটি বিষয়ের উপর বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত শিক্ষা পাবেন যেমন ধরুন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন এর উপর আমি বিস্তারিত শিখেছি, আইন জেনেছি কিন্তু সেখানে কিন্তু প্রায়োগিক কিছুই শেখানো হয় না যেটা একজন আইনজীবীর কোর্ট practice এর জন্য প্রয়োজন। আগেই বলেছি আইন জানা এবং সেই আইনের প্রয়োগ কিভাবে করা হয় তা জানা কিন্তু একটি অন্যটির পরিপূরক। আমি হয়ত এল. এল. এম. করে জেনেছি কিভাবে কোন আইনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মালামাল বেচাকেনা হয়, আন্তর্জাতিক আইনে ক্রেতা বিক্রেতার আইনগত অধিকার ও দায়িত্ব কি কি, কেউ কোন দায়িত্ব পালন না করলে কি হবে আন্তর্জাতিক চুক্তি আইন অনুযায়ী, কোথায় মামলা করতে হবে ইত্যাদি কিন্তু এল. এল. এম. আমাকে শিক্ষাদেয়নি যে কিভাবে মামলা লিখতে হবে, কিভাবে মক্কেলের সাথে কথা বলতে হবে, কিভাবে কোন পদ্ধতিতে আদালতের কাছে মামলাটি কার্যকরীভাবে উপস্থাপন করতে হবে, যে শিক্ষাটি আমি আবার বার-এট-ল ডিগ্রি করতে গিয়ে জেনেছি। তাই আমার কাছে দুইটা ডিগ্রিই সমান মূল্যবান। এর পরও যদি আমাকে উত্তর দিতে হয় যে এল. এল. এম. করবেন নাকি বার-এট-ল ডিগ্রি করবেন আমি বলব বাংলাদেশ এ এখন অনেক ভাল ইউনিভার্সিটি আছে (সরকারি এবং বেসরকারি) যেখানে ওয়ার্ল্ড ক্লাস এল. এল. এম. ডিগ্রি করা যায় কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশে এখনও বার-এট-ল ডিগ্রি সমমানের কোন ডিগ্রি নাই সেহেতু এল. এল. বি. এর পর এল. এল. এম. এর সাথে অথবা শুধু ইংল্যান্ডের ব্যারিস্টার ডিগ্রি থাকলে সেটাএ অবশ্যই বাংলাদেশে পেশাগত সুবিধা দিবে।
সপ্তমমত, বাংলাদেশে আমরা যারা practice করি আমাদের পেশা বার কাউন্সিল এর পেশাগত আচরণ কোড অনুযায়ী চালাতে হয়। আমাদের মধ্য যারা ইংল্যান্ড থেকে ব্যারিস্টার ডিগ্রি নিয়েছেন এবং বাংলাদেশ এ advocate হিসেবে practice করছেন তারা কিন্তু শুধু বাংলাদেশ বার কাউন্সিল দারাই নিয়ন্ত্রিত নয়, ইংলিশ বারের কাছেও দায়বন্ধ। আমাদের আচার আচরণ এমনকি আমাদের facebook স্ট্যাটাসএ কি লেখা যাবে কি যাবে না তারও গাইড লাইন আছে, যার ফলে একজন ব্যারিস্টারকে তার আচার আচরণ, ব্যাবহার, মূল্যবোধ, শব্দচয়ন, পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণ সকল ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সচেতন থাকতে হয়। তাছাড়া, ব্যারিস্টার ডিগ্রির একটা অংশ হল বারটি (12) dinner এ উপস্থিত থাকা। এটি বাধ্যতামূলক। এই dinner গুলা তে prospective Barrister রা ইংল্যান্ডের অনেক প্রথিতযশা আইনজীবী, বিচারক, আইনশিক্ষাবিদের সাথে দেখা করা, কথা বলা এবং অনেক কিছু জানার সুযোগ পান। শুধু ইংল্যান্ডের কেন সেখানে বাংলাদেশের অনেক প্রথিতযশা আইনজীবীর দেখা মেলে এবং ওই ডিনার গুলাতে তারা অনেক মন খুলে উপদেশ দেন, যা বাইরের কোথাও পাওয়া যায় বলে আমি সন্দিহান। এছাড়া এসব ডিনার গুলাতে অনেক সামাজিক আচার আচরণের শিক্ষা থাকে যেটা আমাদের সমাজের জন্য প্রয়োজন। যেমন ইংল্যান্ডে ওয়াইন পরিবেশন করা ইংল্যান্ডের আইন পেশার নর্ম কিন্তু সেখানে যারা ওয়াইন খান না তাদের জন্য আলাদা গ্লাস থাকে, আলাদা non-alcoholic drinks এর ব্যবস্থা থাকে। এই বিষয় থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা আমরা লাভ করি যে কিভাবে মতামত বা জীবনধারণের পদ্ধতির পার্থক্য সত্ত্বেও একই টেবিল একই সাথে খাওয়া যায় কারও বিশ্বাসে আঘাত না করে! আমি মনে করি বাংলাদেশের আইনপেশার ক্ষেত্রে আমাদের সকলের আচার আচরণগত এই উৎকৃষ্টতা জরুরি যেটার অনেক কিছুই বার-এট-ল ডিগ্রিতে শিখতে পারা যায়। আমি অন্তত অনেক উপকৃত হয়েছি সেটা আমার স্বীকার করতে কোন সংকোচ নেই। এই শিক্ষা অনেক গর্বের ব্যাপার।
সর্বশেষে, একজন আইনজীবীর সন্তান হিসেবে বলতে চাই আইন পেশা অনেক সম্মানের পেশা, অনেক পবিত্র পেশা। একজন আইনজীবীর জীবন অনেক সংগ্রামের , অনেক ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়। একজন ভাল আইনজীবী হওয়ার জন্য বহু বছরের সংগ্রাম, বিদ্যার্জন, অধ্যবসায়, অর্থ প্রয়োজন হয়। সিনিয়রদের কাছে শুনেছি যদি একজন ভাল আইনজীবী হতে হয় তো প্রথমত বুজতে হবে আইনজীবী হিসেবে আমাদের দায়িত্ব কি, তারপর কিভাবে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করতে পারি আর এই দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্য আমাদের কি কি যোগ্যতা থাকতে হবে। এর জন্য আমি মনে করি রেগুলার কোর্ট practice আর পড়াশুনার বিকল্প নাই। আইন বিষয়ে যেকোনো উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন সম্মান জনক এবং – যেটা আমি মনে করি বাংলাদেশের আইনজীবীদের continuous professional development এর জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। তবে যেটা প্রয়োজনীয় নয় সেটা হল কোন ডিগ্রিকে ছোট করা বা সেই ডিগ্রি যার আছে তাকে হেয় করা। আমাদের মনে রাখা উচিত যখন আমরা বার কাউন্সিলের নিবন্ধন পরীক্ষায় পাশ করি তখন থেকে আমরা ‘উকিল’। যদিও আমরা advocate লিখি কিন্তু আসলে তো আমরা বাংলার উকিল। আপনি advocate বলেন, barrister বলেন দিন শেষে আমরা উকিল। প্রতিদিন কোর্টের বারান্দায় দেখা হয়, চা কফি আড্ডা হয় অনেক কিছু শেখা হয় আড্ডা মারতে মারতেই! এই শিক্ষার কোন সার্টিফিকেট নাই, নাই কোন tuition fee! তাই আমি মনে করি একজন প্রকৃত উকিল/আইনজীবী কখনো কোন শিক্ষার সুযোগকে ছোট করে না, সার্টিফিকেটকে ছোট করে না, কাউকে অসম্মান করে না, সে সব সময় তার পেশাগত উন্নতির চিন্তা করে, অপরকে অনুপ্রাণিত করে, আইন শিক্ষার প্রায়োগিক এবং পুঁথিগত কোন অর্জনকেই খাটো করে দেখেনা। আমার অনেক কমসময়ের আইন পেশাগত জীবনে উপরোক্ত সামগ্রিক শিক্ষা অর্জনে ইংল্যান্ডের বার-এট-ল ডিগ্রীর অবদান অনস্বীকার্য।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী