ডেসটিনির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অর্থপাচারের আলোচিত মামলাটি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দায়ের করেছিল প্রায় ছয় বছর আগে; কিন্তু এর বিচার আজও শেষ হয়নি। সম্প্রতি এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ বলেছেন, যেভাবে বিচারকাজ চলছে, তাতে আরও দশ বছর লেগে যেতে পারে।
আইন অনুযায়ী মামলাটির বিচার শুরু হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যেই তা শেষ হওয়ার কথা। ৬০ দিনে মামলা নিষ্পত্তির ওপর গুরুত্বারোপ করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের একটি সার্কুলারও জারি আছে।
ডেসটিনির চাঞ্চল্যকর এই মামলাটির মতো আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার বিচার আইনে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শেষ হচ্ছে না। মামলার প্রতিটি ধাপ চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাওয়ার যুক্তি দেখিয়ে আসামিপক্ষের সময়ক্ষেপণ এবং বিচারক সংকট ও মামলার চাপসহ নানা কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের প্রত্যাশা, সবাই আইন-কানুন মেনে চলব।
মামলার অভিযোগ আমলে নেওয়া, অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ থেকে শুরু করে প্রতিটি ধাপে আসামিপক্ষ উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সময়ক্ষেপণ করায় দুর্নীতির বিচারে গতি নেই বলে দাবি দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের। তিনি বলেন, আদালতকে কঠোর হতে হবে। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ না থাকলে সময় চেয়ে আবেদন জানালে বিচারিক আদালত থেকে নামঞ্জুর করা উচিত।
জানা গেছে, দুদকের তফসিলভুক্ত মামলাগুলো দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে ১৯৫৮ সালের দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট অনুযায়ী বিশেষ জজ আদালত স্থাপন করে সরকার। বর্তমানে রাজধানীতে ১২টিসহ সারাদেশে ৩৫টি বিশেষ জজ আদালত রয়েছে। দুদকের মামলার বিচারের এখতিয়ার সম্পন্ন এসব বিশেষ জজ আদালত থেকে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দুদকের মামলা বিচারাধীন ৩ হাজার ৪১২টি। আর এসব আদালতে মামলা বিচারাধীন আছে দেড় লক্ষাধিক। দুদকের মামলার তুলনায় অন্যান্য মামলার সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ায় দুর্নীতির বিচার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এসব বিষয় লক্ষ করে ২০১৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্টে চিঠি পাঠায় দুদক। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ১৯৫৮ সালের দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের ৩ ধারা বিধান মতে বিশেষ জজ আদালত গঠিত হয়। একই আইনের ৬ (ক) ধারা অনুযায়ী দুর্নীতি মামলা আমলে নিয়ে বিচার শুরুর ৬০ দিনের মধ্যে তা নিষ্পত্তি করার কথা। কিন্তু ২০০৩ সালের বিশেষ আদালত (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আইন হওয়ার পর অন্য দেওয়ানি-ফৌজদারি মামলাও বিশেষ আদালতে বিচারের জন্য আসছে। ফলে দুর্নীতি মামলার বিচারে বিচারকরা যথেষ্ট মনোযোগ ও সময় দিতে পারছেন না। আবার জেলা ও দায়রা জজ আদালত থেকে মামলাগুলো বিশেষ জজ আদালতে পাঠানো হচ্ছে না। ফলে বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতগুলোয় অনেক সময় দুর্নীতি মামলার স্বল্পতা দেখা দেয়। এ অবস্থায় দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট-১৯৫৮ অনুযায়ী ৬ (ক) ধারায় প্রদত্ত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ জজদের প্রতি তাগিদ দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় দুদকের ওই চিঠিতে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন থেকে ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর একটি সার্কুলার জারি করে দুদকের মামলার বিচারের ক্ষেত্রে ৬০ দিনের বিধান পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়। দুদকের মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং আইনে ধার্যকৃত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। সার্কুলারে আরও বলা হয়, সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, অধিকাংশ জেলার দায়রা ও মহানগর দায়রা জজ দুর্নীতির সব মামলা বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালতে পাঠাচ্ছেন না। কিছু মামলা নিজ আদালতেই রেখে দিচ্ছেন। কিছু ক্ষেত্রে অধীনস্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ ও যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে পাঠাচ্ছেন। ফলে বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালতগুলোয় দুর্নীতি মামলার স্বল্পতা দেখা দিচ্ছে। এতে বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালতগুলোয় দুর্নীতির মামলা আইনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এ অবস্থায় সব জেলা ও দায়রা জজ এবং মহানগর দায়রা জজকে দুর্নীতির মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিভাগীয় বিশেষ জজ ও বিশেষ জজ আদালতে পাঠানোরও নির্দেশ দেওয়া হয়।
ডেসটিনির মামলায় মাত্র একজনের সাক্ষ্যগ্রহণ
দেশের আর্থিক খাতের ইতিহাসে অন্যতম কেলেঙ্কারির নাম ডেসটিনি কেলেঙ্কারি। ব্যবসায়ের নাম ভাঙিয়ে প্রতারণামূলক এমএলএম পদ্ধতিতে ডেসটিনি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এ ঘটনায় ২০১২ সালে দুটি মামলা করে দুদক। এ দুই মামলায় সাবেক সেনাপ্রধান ডেসটিনি গ্রুপের সভাপতি লে. জেনারেল (অব) হারুন-অর-রশিদ এবং ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রফিকুল আমীনসহ প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ ৪৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৪ মে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। দুই মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে ১৫০ জনকে। হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১৬ সালে মামলা দুটিতে অভিযোগ গঠিত হয়। বর্তমানে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ৫-এ মামলা দুটি বিচারাধীন। জানা গেছে, এ পর্যন্ত ১৫০ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র এক সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এ অবস্থায় গত ২৮ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এ মামলার এক আসামির জামিন শুনানিকালে মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্বের বিষয়টি লক্ষ করে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। আদালত বলেন, এই মামলার এক সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করতে দুবছর সময় লেগেছে। অন্যান্য সাক্ষীর সাক্ষগ্রহণ করে দশ বছরেও বিচার শেষ হবে কিনা, তা নিয়ে আমরা সন্দিহান।
হলমার্কেরও গতি নেই
একইভাবে হলমার্কের আড়াই হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির ঘটনায় ২০১২ সালে ৩৮টি মামলা হয়। তদন্ত শেষে ২০১৪ সালে ১১টি মামলায় অভিযোগপত্র দেয় দুদক। এসব মামলায়ও ২০১৬ সালের মার্চ ও ফেব্রুয়ারিতে চার্জ গঠন হয়। এরপর ১১টি মামলায় ২৮২ সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। অথচ মামলাগুলোয় চার্জশিটে মোট ৮৫৩ সাক্ষী রয়েছেন।
১১ বছর পরও ১৫ বাড়ির মামলায় চলছে সাক্ষ্যগ্রহণ
জোট সরকারের আমলে ১৫টি পরিত্যক্ত বাড়ি নিয়ে দুদকের করা পৃথক ১৫টি মামলার পর পেরিয়ে গেছে ১১ বছর। এসব মামলার বিচারকার্য এখনো সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। ২০০৭ সালে দায়ের করার পর ওই বছরই আসামি মির্জা আব্বাসসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়। এর পর মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে এলে ৫ আসামি হাইকোর্টে পৃথক ১৫টি রিভিশন আবেদন করেন। অভিযোগ পুনর্গঠন ও একটা বিচার চেয়ে করা ১৫ রিভিশন আবেদন গত ৫ এপ্রিল খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ রায়ের ফলে বিচারিক আদালতে এসব মামলা যে পর্যায়ে ছিল, সেই পর্যায় থেকে বিচার চলবে। একইভাবে ওয়ান-ইলেভেনের সময় সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যবসায়ী এমএ হাশেম, বিএনপি নেতা আলতাফ হোসেন চৌধুরীসহ শত শত মামলার আসামির বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলাসমূহের বিচারেও গতি নেই। সূত্র: আমাদের সময়