আজ ২৪ এপ্রিল। দেশের পোশাক শিল্প খাতের এক শোকাবহ দিন। ২০১৩ সালের এই দিনে ধসে পড়ে সাভার বাজার বাসস্ট্যন্ড এলাকার রানা প্লাজার আট তলা ভবন। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় ১১৩৬ জন শ্রমিকের। আহত হন আরও কয়েক হাজার শ্রমিক। স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাণঘাতী এই দুর্ঘটনার রেশ এখনও বয়ে চলছেন আহত শ্রমিক এবং হতাহততের পরিবারের সদস্যরা। আহত শ্রমিকদের বড় একটি অংশই এখনও ফিরতে পারেননি স্বাভাবিক জীবনে, কেউ কেউ পঙ্গু হয়েছেন আজীবনের জন্য। নিহতদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এসব পরিবারে এখনও বয়ে চলেছে অশ্রুর ধারা।
এদিকে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ ওই দুর্ঘটনায় দায়ের করা চারটি মামলার মাত্র একটি নিষ্পত্তি হয়েছে। বাকি তিনটি মামলা এখনও বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। এর বাইরে শ্রম আইনে দায়ের করা ১১টি মামলাও এখনও শ্রম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
জানা গেছে, রানা প্লাজা ধসের পর সম্পদের তথ্য গোপন করার অভিযোগে দায়ের করা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলাটিরই কেবল রায় হয়েছে। এ বছরের ২৯ মার্চ ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ মামলাটির রায় দেন। একই ঘটনায় দায়ের হওয়া হত্যা মামলাটি বিচারাধীন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। আর ইমরাত নির্মাণ আইনে দায়ের করা দু’টি মামলার মধ্যে রাজউকের মামলাটি ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং ইমরাত নির্মাণে দুর্নীতির মামলাটি ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে বিচারাধীন।
দুদকের মামলা
দুদকের দায়ের করা মামলার আইনজীবী রফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানান, ২০১৫ সালের ১২ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ও তার মা মর্জিনা বেগমের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় রানা প্লাজার নির্মাণের তথ্য গোপন করে দুদকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তথ্য দিয়ে ছয় কোটি ৬৭ লাখ ৬৬ হাজার ৯০০ টাকা জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার অভিযোগ করা হয়। গত ২৯ মার্চ এ মামলার রায় দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস।
দুদকের দায়ের করা এই মামলার রায়ে সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও অনাদায়ের আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই মামলায় তার মা মর্জিনা বেগমকেও তিন বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একইসঙ্গে অবৈধভাবে অর্জিত সাভার বাজার রোডের ৬৯/১ বাড়িটির এক-তৃতীয়াংশ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করারও আদেশ দেন আদালত।
হত্যা মামলা
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন এক হাজার ১৩৫ জন। আহত হয়েছিলেন আরও সহস্রাধিক মানুষ। এ ঘটনায় পরদিন সাভার থানায় ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু’র অভিযোগে সোহেল রানাসহ ২১ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। পরে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্ত শেষে ২০১৫ সালের ১ জুন সিআইডির এএসপি বিজয়কৃষ্ণ কর ৪১ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। আসামিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত মৃত্যু ঘটানোসহ আরও কিছু অভিযোগ আনা হয়।
প্রায় এক বছর ধরে মামলাটির পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিসহ বিভিন্ন কার্যক্রম চালানো হয়। এরপর ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বিচার কার্যক্রমের জন্য মামলাটি পাঠানো হয় জেলা ও দায়রা জজ আদালতে। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান ২০১৬ সালের ১৮ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
মামলার ৪১ আসামির মধ্যে মো. শাহ আলম ওরফে মিঠু, মো. আবুল হাসান ও সৈয়দ শফিকুল ইসলাম জনির বিরুদ্ধে আসামি সোহেল রানাকে পালাতে সহযোগিতার জন্য দণ্ডবিধির ২১২ ধারায় এবং বাকি ৩৮ আসামির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগে অভিযোগ গঠন করা হয়। একই বছর অভিযোগ গঠনের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন সাত আসামি। ওই রিট আবেদনের ফলে নিম্ন আদালতে মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত করে উচ্চ আদালত।
হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মিজানুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে ছয় জনের স্থগিতাদেশ বাতিল হয়ে গেছে। কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের স্থগিতাদেশ এখনও রয়েছে। আগামী ১২ মে এই স্থগিতাদেশের শুনানি রয়েছে। সেটা নিষ্পত্তি হলে বিচার কার্যক্রম চালাতে আর কোনও বাধা থাকবে না। আগামী ১৬ মে মামলাটির কার্যক্রমের জন্য পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন বিচারক।
ইমারত নির্মাণ আইনে রাজউকের মামলা
রানা প্লাজা ধসের পরদিনই ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল ইমারত নির্মাণ আইনে সাভার থানায় একটি মামলা দায়ের করেন রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন। এ মামলায় সোহেল রানাসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়। এ মামলাটিরও তদন্ত করে সিআইডি। হত্যা মামলার সঙ্গে একইদিন ২০১৫ সালের ১ জুন পৃথক আরেকটি অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন সিআইডির কর্মকর্তা বিজয় কৃষ্ণ কর। অভিযোগপত্রে সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করা হয়। এই মামলার ১৮ আসামির মধ্যে ১৭ জনই হত্যা মামলা আসামি।
২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। অভিযোগ গঠনের পর আসামিদের মধ্যে তিন জন অভিযোগ গঠনের বিরুদ্ধে ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পৃথক তিনটি রিভিশন মামলা দায়ের করেন। এর মধ্যে দু’জনের আবেদন খারিজ করে দেন আদালত। পোশাক মালিক আনিসুর রহমানের পক্ষে দেউলিয়া বিষয়ক আদালতে আগামী ৭ মে বাতি রিভিশন মামলাটির শুনানির তারিখ ধার্য রয়েছে। আর আগামী ৬ মে মামলাটির সাক্ষ্য নেওয়ার তারিখ ধার্য করেছেন আদালত।
এ মামলার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমানে মামলাটি রিভিশন আদালতে থাকায় সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সেখান থেকে বিচারিক আদালতে নথি এলে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যাবে।’
ইমারত নির্মাণে দুর্নীতির মামলা
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পরপরই ভবন নির্মাণে দুর্নীতির অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। রানা প্লাজা ভবনটি ছয় তলা নির্মানের অনুমোদন থাকার পরও ৯ তলা হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল। এই দুর্নীতির কারণে ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা ও দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় সাভার থানায় ২০১৩ সালের ১৫ জুন একটি মামলা দায়ের করে দুদক। মামলায় প্রথমে ১৭ জনকে আসামি করা হয়। কিন্তু তদন্তে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে রানার প্রভাব খাটানোর বিষয়টি বেরিয়ে আসায় রানাসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১৬ জুলাই আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক মফিদুল ইসলাম।
অভিযোগপত্র দাখিল হওয়ার পর মামলাটি বিচারের জন্য ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতে পাঠানো হয়। মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির পর্যায়ে কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে। এতে ২০১৬ সালের ৬ মার্চ মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দেন এ আদালতের বিচারক। পুনঃতদন্ত শেষে ওই বছরই মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়। এরপর গত বছরের ২১ মে অভিযোগ গঠন করে রানাসহ ১২ জনের বিচার শুরু করেন ঢাকার বিভাগীয় বিশেষ আদালতের বিচারক এম আতোয়ার রহমান।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশারফ হোসেন কাজল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বর্তমানে মামলাটির ১ নম্বর সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। আশা করি, খুব শিগগিরই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করা যাবে। মঙ্গলবার (২৪ এপ্রিল) সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য আছে।’
শ্রম আইনে মামলা
এদিকে, রানা প্লাজা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে শ্রম আইনে ১১টি মামলা দায়ের করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর। সবগুলো মামলাই শ্রম আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।