ফেসবুক, গুগলে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন এবং ইউটিউব, নেটফ্লিক্সে বসানো সাবস্ক্রিপশন প্ল্যাটফর্মের অবৈধ চার্জিংয়ের ফাঁক গলে দেশ থেকে বছরে হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। এসবের প্রতিকার চেয়ে রাষ্ট্রীয় তিনটি দফতরের কাছে ডিমান্ড অব জাস্টিস নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান। নোটিশ হাতে পাওয়ার ১৪ দিনের মধ্যে এর জবাব না দিলে রিট মামলা করা হবে বলেও জানান নোটিশ প্রেরণকারী আইনজীবী।
একইসঙ্গে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগের সচিব এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সভাপতির কাছে নোটিশের কপি পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া এর প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং খাতটিতে টেকসই উন্নয়নের পথে পরিচালিত করতে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নেরও দাবি জানিয়েছেন তিনি। জনস্বার্থে গত (২৬ এপ্রিল) বৃহস্পতিবার পাঠানো এই ডিমান্ড অব জাস্টিস নোটিশে তিনি এমন অর্থপাচার বন্ধে জরুরি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
যে তিন প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ পাঠানো হয়েছে- জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিএর) চেয়ারম্যান, (বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর) বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টলিজেন্স ইউনিটের প্রধান ও বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান।
আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান গণমাধ্যমকে নোটিশ পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এ বিষয়ে হাইকোর্ট থেকে একটি নির্দেশনা রয়েছে, এরপরও নোটিশ পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাইকোর্ট থেকে দেয়া আগের আদেশটি শুধু রাজস্ব ফাঁকির বিষয়ে। আমার নোটিশ বিদেশে অর্থ পাচারের বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে দেয়া।
তিনি জানান, এসব বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে লেখালেখি হলেও তা রোধে কোনো প্রকার গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। ফলে এসব মাধ্যমে অর্থপাচার বেড়েই চলেছে। ২০১৮ সালে এই খাতে লেনদেন দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যার অধিকাংশই বিদেশে চলে যাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
ব্যারিস্টার মাহিন রহমান বলেন, আমরা দেখেছি কিছু কিছু সাবস্ক্রিপশন প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশে বিনা পুঁজিতে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করে নিচ্ছে। গুগল, ইউটিউবের ব্যবসা হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে আরও আগেই। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় লিগ্যাল পদ্ধতিতে রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয়।
ব্যবসা করতে ক্ষতি নেই, কিন্তু তা করতে হবে বৈধ পথে, এমন মত দিয়ে তিনি বলেন, ব্যবসা থেকে যে অর্থ এই প্রতিষ্ঠানগুলো পাচ্ছে তার প্রায় সবটাই যাচ্ছে অবৈধ পথে অর্থপাচারের বহুল প্রচলিত ব্যবস্থা হুন্ডির মাধ্যমে। অন্যটি হচ্ছে ক্রেডিট কার্ড চার্জিংয়ের অপব্যবহারের মাধ্যমে।
তিনি বলেন, এই যে ফেসবুক, গুগল কিংবা ইউটিউব নেটফ্লিক্স বাংলাদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা নিচ্ছে তারা কিন্তু বাংলাদেশের কোনো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিবন্ধিত নয়। বাংলাদেশের সীমারেখার মধ্যে তাদের নেই কোনো অফিস, আর নেই কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্টও। এমনকি এখানে তারা কোনো এজেন্টকেও নিয়োগ দেয়নি, যে বা যারা তাদের হয়ে এদেশে কাজ করবে। তাহলে প্রশ্নটিতো করাই যায়, কীভাবে তারা অর্থগুলো নিচ্ছে?
নোটিশে বলা হয়েছে, প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও ওয়েব; এই তিনটি মাধ্যমকে ব্যবহার করে টিকে আছে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন বাজার। ডিজিটাল সময়ের সুবিধা ও আইটি সেক্টরের ব্যাপক উন্নতির ফলে বাংলাদেশের মানুষ যোগাযোগ ও দৈনন্দিন কাজে ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারে সঠিক তদারকি ও নীতিমালার অভাবের কারণে বাংলাদেশ প্রতিবছর হারাচ্ছে প্রায় হাজার কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুক ও গুগলের ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে ব্যারিস্টার মাহিন এম রহমান বলেন, টার্গেট অডিয়েন্সের কাছে পৌঁছাতে এই দুই চ্যানেলে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে বাংলাদেশ অন্তত ১০০০ কোটি টাকা ব্যয় করছে।
দ্য ডেইলি স্টারে এ বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত খবরের বরাতে এই তথ্য ছাড়াও ব্যারিস্টার মাহিন উল্লেখ করেছেন, দেশের বর্তমান মোট বিজ্ঞাপনী বাজারের ৬২ শতাংশই আন্তর্জাতিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে চলে গেছে। আর ধারণা করা হচ্ছে- ২০১৮ সাল নাগাদ তা দ্বিগুণ বেড়ে ২০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যার প্রায় ৯০ শতাংশই চলে যাবে অবৈধ পথে।
ব্যারিস্টার মাহিন রহমান বলেন, বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। দেশের লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান এখন প্রতিনিয়ত আন্তর্জাতিক এসব প্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞাপন প্রচার কিংবা কনটেন্ট সাবস্ক্রিপশনের জন্য অর্থ দিচ্ছে যা স্রেফ অর্থপাচার।
তিনি জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত অর্থ পরিশোধ প্রক্রিয়াগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে তার অপব্যবহারই হচ্ছে বেশি। ক্রেডিট কার্ড, রেসিডেন্স ফরেন কারেন্সি ডেপোজিট (আরএফসিডি) কার্ড, ফরেন কারেন্সি রেমিট্যান্স কোটার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলো সুনির্দিষ্ট কিছু কাজের বা সুবিধার জন্য বরাদ্দ দিয়েছে। কিন্তু আমরা এখন এগুলোর অপব্যবহারই বেশি দেখছি।
ব্যারিস্টার মাহিন তার নোটিশে বলেছেন, এই অবৈধ অর্থপাচারের মধ্যদিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীচক্র, চোরাচালান ও মাদক পাচারকারী চক্রকে সুযোগ করে দিচ্ছি কি-না সেটিও ভেবে দেখতে হবে। তিনি বলেন, দেশ থেকে অবৈধ পথে হুন্ডির মাধ্যমে কার কাছে অর্থগুলো পৌঁছানো হচ্ছে, তা কারও জানা নেই। হতে পারে এই অর্থই ব্যবহৃত হচ্ছে সন্ত্রাসে কিংবা মাদক পাচারে।