সিরাজ প্রামাণিক:
২০০৮ সালে পারিবারিকভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন প্রকৌশলী আবু হাসান (ছদ্মনাম)। ঘরে ছয় বছরের কন্যা শিশু। স্বামীর অভিযোগ, বিয়ের পর থেকেই স্ত্রীর অসহনশীলতা, পরিবারের সদস্যদের প্রতি অশোভনীয় ও বৈরী আচরণ, যখন তখন বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া, নিজের ইচ্ছামতো বাসায় ফিরে আসা এসব কারণে দাম্পত্য জীবন দুঃসহ হয়ে উঠে। শুধু তাই নয়, স্ত্রী ও তার দুই ভাই এসে একদিন তাকে মারধর করে। একপর্যায়ে তার চিৎকারে অন্য ফ্ল্যাটের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করেন। এ বিষয়ে স্ত্রীর বাড়িতে শালিসের মাধ্যমে সুরাহা করতে চাইলে ব্যর্থ হন। এ অবস্থায় জীবনের শঙ্কা ও নিরাপত্তাহীনতার কারনে থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। এরইমধ্যে কন্যা এবং স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যায় স্ত্রী। স্বামী ফোনে যোগাযোগ করলে তাকে মেয়ের ক্ষতি করার হুমকি দেয়া হয়। বিভিন্নভাবে পরিচিতদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন তার স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি কন্যা শিশুর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে এবং তাকে ফিরে পেতে আইনি সহায়তার জন্য তিনি দ্বারস্থ হন একজন আইনজীবীর কাছে।
পুরুষরা স্ত্রী কর্তৃক মানসিক এবং কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েও সামাজিক মর্যাদার ভয়ে চুপ করে থাকেন। বাংলাদেশে পুরুষদের জন্য কোন বিচারিক ট্রাইব্যুনাল না থাকায় নির্যাতিত পুরুষরা আইনি সহায়তাও নিতে পারে না। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ডিভোর্সের পর পিতা সন্তানের জামানত পায় না। পুত্র সন্তান ৭ বছর এবং কন্যা সন্তান ১৮ বছর পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকার নিয়ম আছে। সন্তানের ভবিষ্যৎ, সামাজিক মর্যাদা, লোকলজ্জা, জেল-পুলিশ আর কোর্ট কাচারির ভীতির কারণে বাধ্য হয়ে স্ত্রীর নির্যাতন নীরবে সহ্য করেও মানিয়ে নিচ্ছেন তারা। মুখ খুলে বলতে পারছেন না নির্যাতনের কথা। কিন্তু একজন নারী আইনি ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ইচ্ছে করলেই ঘটনা সাজিয়ে পুরুষের বিরুদ্ধে থানা কিংবা আদালতে সহজেই নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দিতে পারছেন। কিন্তু ভূক্তভোগী হয়েও একজন পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়ে থানায় গিয়ে সহজে অনেক সময় মামলা করতে পারছেন না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় সংসারে কোনো সমস্যা হলেও স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা দেয়া। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় সমস্যা যৌতুক নয় পরকীয়া। এখনকার বেশিরভাগ নারী যৌথ পরিবারে থাকতে চান না। এ ছাড়া স্বামী, বাবা-মাকে দেখভাল করবেন, তাদের বাড়তি যতœ নেবেন- এসব নানা বিষয় সংসারে ঝামেলা ও বোঝা মনে করেন। পুরুষ নির্যাতনের অরেকটি বিষয় হচ্ছে- প্রযুক্তির অপব্যবহার। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে অনেক নারী পুরুষকে ট্রাপে ফেলেন। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করেন। এ ছাড়া অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। অনেক নারী আছেন যারা শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবরকে মামলা দিয়ে হয়রানি করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিকার না থাকায় পুরুষরা বিপদে পড়ে যান। অনেক নারী আছেন যারা শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবরের সঙ্গে থাকতে ঝামেলা মনে করেন। এ ক্ষেত্রে আলাদা থাকতে পছন্দ করেন। আর পুরুষরা বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে না পারার কষ্ট কাউকে বলতে পারেন না। সম্মানের কথা চিন্তা করে চুপ থাকেন।
নারী নির্যাতনের খবর ফলাও করে প্রতিদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হলেও পুরুষ নির্যাতনের কথা সেভাবে আসে না। নির্যাতিতদের কেউ শারীরিক, কেউ মানসিক, কেউ দৈহিক-আর্থিক, কেউ সামাজিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। ঘরে-বাইরে এ ধরনের নির্যাতন প্রায়ই ঘটছে। তুলনামূলক কম হলেও নির্যাতিত পুরুষের সংখ্যা এদেশে কম নয়। অথচ নির্যাতনের খবরে নারীদের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে বর্তমান সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন পুরুষরা। বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনে ৫টি ট্রাইব্যুনাল তৈরি হলেও পুরুষদের জন্য নেই একটিও। ফলে আইনি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক ভুক্তভোগী। এতে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, বিদ্যমান আইনেও বৈষম্যের শিকার নির্যাতিত পুরুষ। অথচ সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে অনুযায়ী রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে বাধ্য। একই সাথে, ২৬ (২)অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্র সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্য কোন আইন প্রণয়ন করবে না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হলে তা বাতিল হয়ে যাবে। তাছাড়া, ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী বলে ঘোষনা করেছে।
অবস্থাদৃষ্টে নারী কর্তৃক নির্যাতিত অনেক পুরুষের মতো ‘পুরুষ নির্যাতন দমন’ আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করছেন দেশের খোদ প্রধানমন্ত্রীও। যিনি নিজেও একজন নারী। চলতি বছরের অর্থাৎ ২০১৭ সালের মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের মতো ভবিষ্যতে পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আইনও করা লাগতে পারে। হয়তো সেদিন আসতে পারে, দেখা যাবে আমাদের ও রকম আইনও (পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আইন) করতে হচ্ছে।’ ২০১৬ সালে জাতীয় সংসদের এক অধিবেশনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমও পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আইন করার দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু তার দাবির দৃশ্যত কোনো প্রতিফলন ঘটেনি আজও।
সমাজবিজ্ঞানী ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, বর্তমান সময়ে দাম্পত্য জীবনে ভালবাসার বন্ধন আগের চেয়ে অনেক হালকা হয়ে উঠেছে। মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক স্খলন, লোভ-লালসা, উচ্চ বিলাসিতা, পরকীয়া, মাদকাসক্তি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, স্বাবলম্বী হওয়া, বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব, অবাধ ভিনদেশি সাংস্কৃতিক প্রবাহসহ নানা কারণেই এমনটা ঘটছে। যার চরম পরিণতি হচ্ছেÑ সংসারের ভাঙন ও নির্যাতন। যেখানে ভুক্তভোগী উভয়ই। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত শ্রেণির অনেকেই প্রতিনিয়ত ভুগছেন পারিবারিক যন্ত্রণায়। নির্যাতিত নারীর পাশে সমাজের অনেকেই সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন। কিন্তু পুরুষশাসিত এ সমাজে পুরুষও যে নির্যাতিত হতে পারে তা ভাববার অবকাশ যেন নেই কারোরই। ফলে আড়ালেই থেকে যাচ্ছে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাগুলো। ফলে দিনের পর দিন বাড়ছে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনা।
কেস ষ্টাডি-২। সুজন রহমান (ছদ্মনাম) কিছুদিন আগে তিনি বিয়ে করেন বুয়েটের কোয়ার্টারে বসবাসকারী উচ্চ শিক্ষিত এক তরুণীকে। প্রথমত শারীরিক সম্পর্ক গড়তে না দেওয়ায় ওই প্রকৌশলী ধারণা করেছিলেন নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছেন না নববধূ। পরে হানিমুনের উদ্দেশে ব্যাংককে গিয়ে ভুল ভাঙে তার। সেখানে ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে রাতযাপন, মাতাল অবস্থায় ঘরে ফেরার দৃশ্য রীতিমতো মুষড়ে দেয় তাকে। দেশে ফিরে কিছুদিন অপেক্ষার পর অবস্থা সামাল দিতে না পারায় বিষয়টি তিনি মেয়েটির অভিভাবকদের জানান। এতে ঘটে হিতে বিপরীত। নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দেন ওই নারী। পরে কাবিননামার ২০ লাখ টাকা মোহরানা আদায় করে প্রকৌশলীকে ডিভোর্স দেন ওই নারী।
পাঠক! উপরের গল্প থেকে সহজেই অনুমেয় যে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর অপপ্রয়োগ রোধে এর প্রায়োগিক পদ্ধতির কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পাশাপাশি ‘পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ’ আইন তৈরিও অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। কারণ বিচারপ্রার্থীর বিচার পাওয়ার অধিকার যেমন আছে, ঠিক বিচারটিও বাদী-বিবাদীর সমান সুযোগের ভিত্তিতে হওয়া উচিত। পুরুষ নির্যাতনবিরোধী আইন করা মানে নারীকে ছোট বা হেয় করা নয় আবার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন মানেও কথায় কথায় পুরুষকে হেনস্তা করা নয়। আইন দুটি থাকবে একটি আরেকটির পরিপূরক হিসেবে।
“পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আইন” বাস্তবায়নের লক্ষে রাস্তায় নেমেছেন জনৈক খায়রুল। নিজ বাসায় প্রধান কার্যালয় করে গঠন করেছেন “পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আন্দোলন বাংলাদেশ (পুনিপ্রআবিডি)” নামের একটি সংগঠন। প্রথম দিকে একা আন্দোলন চালিয়ে আসলেও বর্তমানে তার সাথে যুক্ত হয়েছেন আরো অনেক নির্যাতিত পুরুষ। ইতিমধ্যে ১৫টি জেলায় পুনিপ্রআবিডি’র কমিটিও গঠন করা হয়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধ আইনের মাধ্যমে পুরুষদের হয়রানি বন্ধ ও পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ আইন বাস্তবায়নের জন্য সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে ২১ দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ঃ
১. নারী নির্যাতন ও যৌতুক মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হলে বাদীকে কঠিন শাস্তির আদেশসহ পর্যাপ্ত জরিমানার ব্যবস্থা করা।
২. বিনা অপরাধে জেল খাটালে বাদীকে ক্ষতিপূরণসহ শাস্তি দেয়া।
৩. স্ত্রীর মামলায় সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না।
৪. তদন্ত ছাড়া শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ-দেবরকে আসামি করা যাবে না।
৫. স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে তদন্ত সাপেক্ষে স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার ব্যবস্থা।
৬. সন্তান হওয়ার পর স্ত্রী স্বেচ্ছায় অন্যের কাছে চলে গেলে সন্তানকে স্বামীর হেফাজতে দেয়া।
৭. স্ত্রী স্বেচ্ছায় স্বামীকে তালাক দিলে সে ক্ষেত্রে স্বামীর কোনো দোষ না থাকলে স্ত্রী জরিমানাস্বরূপ স্বামীকে দেনমোহরের সমপরিমাণ টাকা পরিশোধ করবে।
৮. বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ত্যাগ করতে বাধ্য করলে স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক দেয় তাহলে স্বামীকে যাতে দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করতে না হয় তার ব্যবস্থা করতে হবে। অবশ্যই সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে।
৯. স্বেচ্ছায় স্ত্রী শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে গেলে কোনো খোরপোষ পাবে না।
১০. স্ত্রী নিজ পিত্রালয়ে অবস্থানকালীন কোনো দুর্ঘটনা ঘটালে বা আত্মহত্যা করলে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া মিথ্যা মামলা দিয়ে স্বামীকে যাতে হয়রানি করতে না পারে সেই ব্যবস্থা করা।
১১. মহিলা কর্তৃক পুরুষ যৌন নির্যাতনের শিকার হলে ওই মহিলার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলার ব্যবস্থা করা।
১২. তালাকের পর দেনমোহর ও খোরপোষের মামলা ছাড়া অন্য কোনো মামলা দিয়ে স্বামীকে যাতে হয়রানি করতে না পারে।
১৩. পুরুষ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি আইনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ বিবেচনা না করা।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘ পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধে আলাদা আইন হয়েছে।’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা।