প্রতীকী ছবি

নারী আইনজীবীরাও যৌন হয়রানির শিকার: গবেষণা

যৌন হয়রানি থেকে বাদ যাচ্ছে না বিচারিক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নারী আইনজীবীরাও। দেশের কোনো আদালতেই হাইকোর্টের গাইডলাইন অনুযায়ী যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠন করা হয়নি। ফলে নারী বিচারক, আইনজীবী ও বিচার-সংশ্লিষ্ট অন্য নারীরা নিজে যখন যৌন হয়রানির শিকার হন, তখন তার প্রতিকার পান না। তাই যৌন হয়রানির শিকার বেশির ভাগ নারী বিষয়টি চেপে যান।

শ্রম আদালতের একজন নারী আইনজীবী অভিযোগ করেছেন, এক জেলা জজের খাসকামরায় তাকে দেখা করতে বলা হয়। প্রথমবার দেখা করার পর বিষয়টি তার কাছে ভালো না লাগায় তিনি আর ওই জেলা জজের ডাকে সাড়া দেননি। ফলে এই নারীর আপিল শুনানির চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকা একটি মামলা ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেন ওই জজ। কিন্তু বিষয়টি তিনি কাউকে বলতে পারেননি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত ‘বিচারব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ: প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক সম্মেলনে এক গবেষণার ফলাফল এবং আলোচকদের বক্তব্য থেকে এ চিত্র উঠে এসেছে। সম্মেলনে প্রতিটি আইনজীবী সমিতিতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠনের দাবি তোলা হয়েছে।

ব্লাস্টের ‘পাওয়ার’ প্রকল্পের আওতায় গত বছরের ৩১ এপ্রিল থেকে ২৯শে মে পর্যন্ত ঢাকা, খুলনা ও কুষ্টিয়ায় একটি গবেষণা করা হয়। যেখানে ব্লাস্টের সমতাভিত্তিক ফেলোশিপের আওতায় গবেষণার তথ্য সংগ্রহ করেন আইন বিষয়ে পড়ুয়া তিনজন শিক্ষার্থী। এ গবেষণাটি প্রতি জেলায় ৪০ জন করে বিচারক, আইনজীবী, আদালতে কর্মরত নারী স্টাফ, আইনজীবী সমিতির সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে তৈরি করা হয়েছে। মোট তিন জেলার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে গবেষণায়। তিন জেলার ফলাফলে যে বিষয়গুলোতে মিল ছিল তা হলো যৌন হয়রানির প্রতিকার না পাওয়ার পরই আছে অবকাঠামোগত সমস্যা। নারী বিচারপতি, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট নারীদের জন্য নেই আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা। নেই সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য ব্রেস্টফিডিং কর্নার, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র। এবং নারীদের বসার জন্য কমন রুমও নেই। বিচার চাইতে আসা মানুষদের ধারণা নারী বিচারক বা আইনজীবীরা পুরুষদের তুলনায় কম দক্ষ। একইভাবে আইন-সংশ্লিষ্ট জ্যেষ্ঠ পুরুষদের অনেকেই তাদের একইভাবে মূল্যায়ন করেন। এমনকি বিচার-সংশ্লিষ্ট নারীদের পদোন্নতি ভালো চোখে দেখেন না তাদের পুরুষ সহকর্মীরা।

যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠনের দাবি জানান সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি নাইমা হায়দার। তিনি জানান, প্রায় ৩০ বছর আগে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে তিনিই একমাত্র নারী শিক্ষক ছিলেন। শিক্ষার্থীদের বাকি সবাই ছিল ছেলে। পরিবার থেকে বাধা এসেছে এ কাজে। তবে তিনি দমে যাননি। পরবর্তীতে তিনিই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের ভর্তির নিয়ম চালু করেন। এমনকি মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেটের চাবি কবজা করতে দৌড়াতে হয়েছে তাকে। নাইমা হায়দার প্রথম নারী সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর মতে, নিজেকে নারী বা পুরুষ না ভেবে মানুষ ভাবতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নিজেকে প্রতি পদে পদে প্রমাণ করেই সামনে অগ্রসর হতে হবে।

নাইমা হায়দার আরো বলেন, বিচার ব্যবস্থাসহ অন্যান্য পেশায় নারীরা যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন তা হতে উত্তরণের জন্য নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে এবং স্ব-উদ্যোগে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি বিচারব্যবস্থ’ায় নারীর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করার সুপারিশ প্রদান করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক এবং এ গবেষণার মুখ্য গবেষক তাসলিমা ইয়াসমিন বলেন, পারিবারিক সমর্থনের অভাব, পরিবারের দায়িত্ব পালনের চাপ ও যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে আইনজীবী নারীরা উচ্চপর্যায়ে যাওয়ার আগেই ঝরে পড়ছেন। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেও অনেক নারী অন্য পেশা বেছে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এইড অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস কমিটির চেয়ারম্যান ও নির্বাচিত সদস্য জেড আই খান পান্না গণমাধ্যমকে বলেন, যৌন হয়রানি নিরসন কমিটি গঠনে ২০০৯ সালের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা জরুরি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের উপর জোর দেয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন অর্গানাইজেশন ও মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে চাপ প্রয়োগ করেছি। বিচার ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি গ্রহণ এবং সুপ্রিম কোর্ট বার সহ বিভিন্ন আইনজীবী সমিতিতে যৌন হয়রানি মুক্ত কর্ম পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রতিটি আইনজীবী সমিতিতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ ও ফলোআপের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, কোনো আইনজীবী নারী যদি জড়িত সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম পরিচয় প্রকাশ করতে পারে তাহলে তাদেরকে যথাযথ বিচারের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে ব্লাস্টের পরিচালক ও আইন উপদেষ্টা এসএম রেজাউল করিম বলেন, আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে বিচারক, আইনজীবী ও বিচার কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত নারীরা লজ্জা, ভয়, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, পারিবারিক চাপ ও পেশাগতভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে মুখ খোলেন না। এমনকি এ বিষয়ে কোথায় অভিযোগ করতে হবে সেটাও তারা জানেন না। এক্ষেত্রে প্রতিটি আইনজীবী সমিতিতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠন করার পর কোনো ভুক্তোভোগী নারী অভিযোগ করলে জাজমেন্টের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে।