‘গণহত্যা বলার মত যথেষ্ট তথ্য ও প্রমাণ আছে। তাই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই হবে। এজন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদসহ সবার একসঙ্গে কাজ করা খুবই জরুরি। কারণ, নিরাপত্তা পরিষদ চাইলে এই বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে।
এভাবেই বলছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ফিলিপ রুডক। সোমবার (৪ জুন) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনে ‘জবাবদিহিতা : আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও রোহিঙ্গা সংকট’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে এসব কথা বলেন ফিলিপ রুডক। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস ওই আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করে।
মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর যে নিপীড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার তদন্ত ও বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) মাধ্যমে করা সম্ভব বলে মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। বক্তারা বলেন, “সেক্ষেত্রে আগামী ১১ জুনের মধ্যে বাংলাদেশের কাছে আইসিসি যে তথ্য চেয়েছ তা দেওয়া উচিত। যার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও ‘গণহত্যা’র বিষয়ে মিয়ানমারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।”
সেমিনারে আইসিসির উদ্যোগ ও বাংলাদেশের করণীয় নিয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বাংলাদেশের কাছে যে তথ্য ও প্রমাণ চেয়েছে সেগুলো দেওয়া উচিত। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মূল ভিত্তি ‘রোম বিধি’ অনুযায়ী আইসিসি চাইলে মিয়ানমার যে নীপিড়ন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার তদন্ত করতে পারে। কারণ, অনেক মানুষ হত্যা করা হয়েছে। সাত লাখেরও বেশি মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। যার মধ্যে অর্ধেক শিশু।’
বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ আরো বলেন, “যে মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো ঘটেছে তা আমলে নিয়ে আইসিসি চাইলে তার বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। কারণ এই অপরাধের যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে। আর বাংলাদেশ ‘স্টেট পার্টি’ হিসেবে এখানে ভূমিকা পালন করতে পারে।”
আলোচনায় উঠে আসে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে সংঘটিত জাতিগত নিধনযজ্ঞের বিভিন্ন দিক। যেখানে বলা হয়, মে মাসে ৪০০ রোহিঙ্গা নারীর পক্ষে তাদের স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে জমা দেন আইনজীবীরা। ওই আইনজীবীরা মনে করেন, ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতই একমাত্র ভরসা।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রসিকিউটর কেট ভিগনেসওয়ারেন বলেন, ‘হত্যা ও নিপীড়নের পর মানুষ বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে আইসিসি ভৌগোলিক বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। রোম বিধি ধারা-১২ অনুযায়ী মিয়ানমারকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব। এ ছাড়া যেহেতু মিয়ানমার হত্যা ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আইনি উদ্যোগ খুবই জরুরি। গণহত্যার বিচার কিংবা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিায়নমারকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতেই হবে। এ ক্ষেত্রে আইসিসি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একই সাথে মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করতে হবে। আর এটা করা সম্ভব। কারণ, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার যে হত্যা, ধর্ষণ, নীপিড়ন করেছে, তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। সেজন্য শুধু দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এর সমাধান সম্ভব নয়। বহুপক্ষীয় চাপের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাদান করতে হবে। রাশিয়াকেও এ ক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে নিতে হবে।’
অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলেন, ‘মিয়ানমারকে যতক্ষণ পর্যন্ত আইনি বাধ্যবাধকতায় আওতায় আনা না যায়, ততক্ষণ তারা বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। সেই কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও জাতিসংঘকে উদ্যোগী হয়ে মিয়ারমারকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ যেহেতু আইসিসির সদস্য, সেই ক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচার কাজে আমরা বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারি । এজন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত আইসিসির চাওয়া তিনটি বিষয়ে তথ্য প্রমাণ দেওয়া।’