সংসারের হাজারো কাজ সামলিয়ে পেশাগত ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাচ্ছেন নারী। ঝুঁকিপূর্ণ কোনো পেশাতেই আর পিছিয়ে নেই তারা। এমনকি গাড়ি চালানোর মতো একটু ভিন্নধর্মী পেশাতেও তাদের যোগদান ও সাফল্য প্রশংসার যোগ্য। তাই সরকারি প্রতিষ্ঠানেও কদর বেড়েছে নারী গাড়িচালকদের। গত চার বছরে সরকারিভাবে গাড়িচালক হিসেবে প্রায় এক হাজার নারী চাকরি পেয়েছেন।
সরকারিভাবে ২০১৪ সাল থেকে নারী গাড়িচালকদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। সে বছর প্রথমবারের মতো নারী চালক নিয়োগ দেয় সরকার। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে নিয়োগের মধ্য দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু। ইতিমধ্যে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ ২০ জন নারী চালক নিয়োগ দিয়েছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন (ইসি), মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংক ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নারী চালক নিয়োগ দিয়েছে। এর বাইরেও অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে নারী গাড়িচালক রয়েছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গাড়িচালক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পুরুষ ও নারী চালকদের কথা উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত দেশে ১৭ লাখ লাইসেন্সধারী চালকের মধ্যে নারীর সংখ্যা ২৪ হাজার ২২৫। তাদের মধ্যে অপেশাদার লাইসেন্স রয়েছে ২৩ হাজার ৫২২ নারীর। আর পেশাদার চালক হিসেবে লাইসেন্স নিয়েছেন প্রায় দেড় হাজার নারী।
একটা সময় সড়কে কোনো নারীকে গাড়ি চালাতে দেখে পথচারীরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সে মানসিকতার পরিবর্তন হয়েছে। জেলা-উপজেলা শহর, দুর্গম অঞ্চলে নারীরা এখন মোটরসাইকেল ও গাড়ি চালাচ্ছে যথেষ্ট দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে।
রাজধানীতে গাড়ি চালাচ্ছেন এমন এক নারী মিলিয়া খানম। গত ২০ মে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তিনি জানান, অর্থাভাবে সপ্তম শ্রেণিতেই তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। প্রতিবেশীর পরামর্শে কেয়ার নামক এক এনজিওতে ড্রাইভিং বিষয়ে ৬ মাসের ট্রেনিং নেন। পরে ২০১০ সালে কেয়ারেই তার চাকরি হয়। প্রায় ৭ বছর তিনি সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় গাড়ি চালিয়েছেন। এর মধ্যে পড়াশোনা করে এইচএসসি পাস করেছেন। বিআরটিসি থেকেও নিয়েছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স। অভাবের সংসারে ৬ ভাইবোনের সংসার টানছেন তিনিই।
রাজধানীতে গাড়ি চালানো বিষয়ে মিলিয়া খানম জানালেন, তার ৮ বছরের গাড়ি চালনার ইতিহাসে একটিও দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিদিন সাড়ে ৯ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা তার আছে। তবে সড়কে পুরুষ চালকরা নারীদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। তাই তারা কখনও কখনও সমস্যা করে।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, নারীরা শুধু ভালো চালকই নয়, যত বেশিসংখ্যক নারী স্টিয়ারিং ধরছে, দুর্ঘটনার হার ততই কমে আসছে।
এ ব্যাপারে সম্প্রতি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নারীরা ঠাণ্ডা মাথায় সংযত হয়ে গাড়ি চালান। দুর্ঘটনাও কম ঘটান। তাই নারী চালকের সংখ্যা বাড়াতে হবে।’
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সড়কে আমরা গাড়িচালক নারী, না পুরুষ- বিবেচনা করি না। আমরা গাড়িচালকের লাইসেন্স দেখে থাকি। আমাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, রাজপথে পুরুষ চালকদের চেয়ে নারীদের বেশি নিরাপদ মনে হয়েছে। নারীচালকদের ধৈর্যের সঙ্গে সাবধানে গাড়ি চালাতে দেখি। তাদের মধ্যে ওভারটেকিং ও আগে ছুটে চলার প্রবণতা কম।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, পুরুষ গাড়িচালকদের অধিকাংশ নেশায় আসক্ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নারী গাড়িচালক নেশায় আসক্ত- এমন কথা শোনা যায়নি। নারীদের ড্রাইভিংয়ে বেশি করে সুযোগ দিলে দেশে অকারণ প্রাণ হারানোর সংখ্যা কমবে। রাজপথে মানুষও থাকবে নিরাপদ। সমকাল