মানবতায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আন্তর্জাতিক সম্মাননা ‘অরোরা পুরস্কার’ জিতে নিয়েছেন রোহিঙ্গা আইনজীবী ড. কিয়াও হ্লা অং। পুরস্কার বাবদ প্রাপ্ত ১১ লাখ ডলারের বেশিরভাগটাই রোহিঙ্গাদের কল্যাণে কাজ করা সংগঠনগুলোকে দিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা জানিয়েছেন। সাক্ষাৎকারে তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিতে মিয়ানমারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন। রাষ্ট্রের স্বীকৃতিহীন রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কয়েক দশক ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন কিয়াও হ্লা অং। তাকে তার কাজের জন্য ১২ বছর জেলেও কাটাতে হয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অটোম্যান তুর্কিদের জাতিগত শুদ্ধি অভিযানের অংশ হিসেবে আর্মেনিয়ায় সংঘটিত গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ ও তাদের উদ্ধারকারীদের পক্ষ থেকে অরোরা পুরস্কার নামের আন্তর্জাতিক সম্মাননা প্রদান করা হয়। মানবিক বোধের জাগরণে অবদান রাখা ব্যক্তিরা আর্মেনীয়-আমেরিকান লেখক ও অভিনয়শিল্পী অরোরা মার্ডিগানিয়ানের নামে প্রচলিত পুরস্কারটির জন্য মনোনীত হন। আর্মেনিয়ার অরোরা হিউম্যানিটারিয়ান ইনিশিয়েটিভ ফাউন্ডেশন এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইঙ্ক (নিউইয়র্ক, ইউএসএ) ও হানড্রেড লাইভস-এর সম্মিলিত উদ্যোগে এই সম্মাননার আয়োজন করে। ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল থেকে আর্মেনিয়ার ইয়েরেভানে প্রতি বছর এই সম্মাননা প্রদানের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। নিয়ম অনুযায়ী, অরোরা পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি নগদ এক লাখ ডলার পান, আর মানবিক কর্মকাণ্ডে ব্যয়ের জন্য বাকি ১০ লাখ ডলার অনুপ্রেরণাদানকারী অন্য কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে মনোনীত করতে পারেন। চলতি বছর এপ্রিলে আরও দুই মানবতাবাদী ব্যক্তির সঙ্গে রোহিঙ্গা আইনজীবী ড. কিয়াও হ্লা অং ওই সম্মননার জন্য মনোনীত হন।
সহিংসতা থেকে বাঁচতে রাখাইন ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ড. হ্লা কিয়াও। নেদারল্যান্ডসের নির্বাসিত জীবনের মনবেদনা তাকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় বঞ্চনা আর দীর্ঘশ্বাসের স্মৃতিভরা রাখাইনে। গত বছর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ এইটিন এর সাংবাদিক দেবায়ন রায়কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বর্তমান পরিস্থিতির পাশাপাশি বিগত স্মৃতি তুলে ধরেছেন ড. হ্লা কিয়াও। এখন তিনি কাজ করছেন শরণার্থীদের জন্যই। দায়িত্ব পালন করেছেন ইউরোপিয়ান রোহিঙ্গা কাউন্সিল এর চেয়ারম্যান হিসেবে। ১০ জুন (রবিবার) আর্মেনিয়ায় তিনি তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘অরোরা সম্মাননা’ গ্রহণ করেন।
সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে ড. হ্লা কিয়াও বলেন, ‘আমার সম্প্রদায়ের মানুষেরা মিয়ানমারে ভয়াবহ প্রতিবন্ধকতার শিকার। তারা তাদের সাহস হারিয়েছে, আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে, নিরক্ষর থেকে যাচ্ছে এবং ফলশ্রুতিতে তাদের হাতে টাকা-পয়সাও নেই। আমার সম্প্রদায়ের মানুষদের এমন বৈষম্যের শিকার হওয়ার বাস্তবতা হৃদয়বিদারক। মানবাধিকারবঞ্চিত সকল মুসলিমদের গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি হিসেবে দেওয়া অরোরা পুরস্কারের সহায়তায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আরও বেশি করে দৃশ্যমান হবে।’
সম্মাননা গ্রহণের দিনেই আর্মেনিয়াতে বসেই টেলিফোনে রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দেন অং। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমরা এ ভূমিরই লোক। এ সরকার আমাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করছে। আমরা মিয়ানমারের নাগরিক, তাহলে আমরা কেন রাষ্ট্রহীন হতে যাব? আমাদের আবাস ছেড়ে আমরা অন্য দেশে যেতে পারব না।’ রয়টার্সকে অং জানান, অরোরা পুরস্কারবাবদ প্রাপ্ত ১১ লাখ ডলারের বেশিরভাগটাই রোহিঙ্গাদের কল্যাণে কাজ করা সংগঠনগুলোকে দিয়ে দেবেন।
দ্য রোহিঙ্গা প্রজেক্ট-এর হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ৪০ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। এর বেশিরভাগই ১৯৮২ সালের পর থেকে তাদের আদি ভিটার বাইরে বসবাস করছেন। ১৯৮২ সালে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে দেশের স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার পর রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন হয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা বলছে, রাষ্ট্রহীন ১ কোটি মানুষের মধ্যে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ‘রাষ্ট্রহীন’ এ রোহিঙ্গারা তাদের পরিচয়, অধিকার ও চাকরি সবকিছু থেকে বঞ্চিত।