সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনা করা ব্যয়বহুল। এ কারণে উচ্চ আদালতে মামলা পরিচালনা করা একজন গরিব মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় নয়। আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনা করতে দুইজন আইনজীবী নিয়োগ করতে হয়। একজন হলেন অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড আর অন্যজন মামলা পরিচালনার জন্য সিনিয়র আইনজীবী।
অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডের কাজ হল মামলার পেপারবুক তৈরি করা। এখানে ন্যূনতম ১৫টি পেপারবুক তৈরি করতে হয়। ক্রিমিনাল মামলায় একটি পেপারবুক তৈরি করতে ন্যূনতম ১০ হাজার টাকার প্রয়োজন হয়। অপরদিকে অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডকে ফি এবং সিনিয়র আইনজীবীকে শুনানির জন্য অর্থ দিতে হয়।
ফলে একটি ফৌজদারি মামলার বিপরীতে দণ্ডিত আসামি বা কয়েদির জন্য প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল অফিস প্রতিষ্ঠার ফলে সুবিধাবঞ্চিত বা আর্থিকভাবে অসচ্ছল মানুষের জন্য আইনি সেবা পাওয়ার পথ অনেকটা সুগম হয়েছে।
আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলার আসামি পঞ্চগড়ের মনছুরা বেগম (৭০) ২০০৩ সাল থেকে কারাগারে আছেন। ধর্ষণের কাজে সহযোগিতা করার দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ২০০৬ সালে উচ্চ আদালতেও দণ্ড বহাল থাকে। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে তিনি সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আর যেতে পারেননি। ১৫ বছর ধরে তিনি কারাগারে আছেন।
একইভাবে ডাকাতির মামলায় লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার আজাদ (৪০) যাবজ্জীবন দণ্ড নিয়ে কারাগারে আছেন। বিচারিক আদালতের দণ্ড হাইকোর্টেও বহাল থাকে। তিনিও আর্থিক কারণে আপিল বিভাগে যেতে পারেননি। ১৯৯৯ সাল থেকে তিনি কারাগারে আছেন। আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে তারা আইনি লড়াই করতে পারছেন না। তারা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে চান। আইনি সহায়তা পেতে তারা বাধ্য হয়ে সুপ্রিমকোর্টের লিগ্যাল এইডের দ্বারস্থ হয়েছেন।
সুপ্রিমকোর্টের লিগ্যাল এইডের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিল্লাল খসরু গণমাধ্যমকে বলেন, কারাবন্দি মনছুরা ও আজাদ দোষী না নির্দোষ, সেটা আদালত চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করবেন। আইনি সেবা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। তারা আইনি লড়াই করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চান। তাই তারা সুপ্রিমকোর্টের লিগ্যাল এইডের দ্বারস্থ হয়েছেন। লিগ্যাল এইড তাদের আইনি সেবা দেবে।
সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল অফিস সূত্র জানায়, অসহায়, হতদরিদ্রদের আইনি সেবা দিতে নিরলসভাবে কাজ করছে সুপ্রিমকোর্ট এইড কমিটি। ক্রিমিনাল আপিল, ক্রিমিনাল রিভিশন, দেওয়ানি আপিল, দেওয়ানি রিভিশন, পিটিশন জেল আপিল এবং লিভ টু আপিলের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল অফিস সব ধরনের আইনি সহায়তা দিয়ে থাকে।
২০১৫ সালে লিগ্যাল এইড প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৮ সালের মে পর্যন্ত ৮৮৩টি মামলা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৪৬৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তির হার প্রায় ৫৩ শতাংশ। শুধু মামলা নিষ্পত্তি নয়, বিচারিক আদালতে চলমান মামলা, বিভিন্ন বিরোধ, চাকরি সংক্রান্ত ও পারিবারিক বিষয়ে প্রতিদিন আইনি সেবাপ্রার্থীরা আসেন।
২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮ হাজার ৩৩৬ জন মৌখিক আইনি পরামর্শের জন্য এসেছেন। মাসে ২৫৫ জনের অধিক মৌখিক পরামর্শ নিয়েছেন। আর এদের বড় অংশই নারী। সুপ্রিম কোর্টের লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ও লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন গণমাধ্যমকে বলেন, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি গরিব-অসহায় মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র যে ভূমিকা রাখছে, সেটি বাস্তবায়নে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এখানে আইনজীবীরা প্রায় বিনা টাকায় আইনি সেবা দিচ্ছেন। এটা গরিবদের জন্য বিরাট একটি প্রাপ্তি।
তিনি আরও বলেন, যারা অর্থের অভাবে মামলা পরিচালনা করতে পারে না, তাদের নিয়ে কাজ করছে লিগ্যাল এইড। বর্তমানে সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল এইডের কার্যক্রম অনেকাংশ বেড়েছে। গরিব মানুষ সব ধরনের আইনি সেবা পাচ্ছেন। সুপ্রিমকোর্টের লিগ্যাল এইড গরিবদের জন্য আইনি আশ্রয় কেন্দ্র বলা চলে।
সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল এইডের কোঅর্ডিনেটর রিপন পৌল স্কু গণমাধ্যমকে বলেন, সুপ্রিমকোর্ট লিগ্যাল এইড গরিববান্ধব একটি সেলে পরিণত হয়েছে। এখানে অত্যন্ত যত্নসহকারে অসহায় ও নিঃসম্বল হতদরিদ্রের সেবা দেয়া হয়। যাতে করে সরকারি এ সেবা দেশের তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছানো যায়।
উল্লেখ্য, বিনা বিচারে দীর্ঘদিন কারাবন্দি রিপনসহ বেশ কয়েকজন লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে কারামুক্তি পেয়েছেন। প্রতিদিনই বাড়ছে তাদের আইনি সেবার মান। দেশের উচ্চ আদালতে লিগ্যাল এইড কমিটি এখন যেন গরিবদের আইনি সেলে পরিণত হয়েছে। যুগান্তর