সিরাজ প্রামাণিক:
দুই কর্মঠ সন্তান, স্ত্রী, নাতী-নাতনী নিয়ে ভালই কাটছিল রহিমা খাতুনের সংসার। একদিন সন্ধ্যায় প্রতিপক্ষরা তাদের বাস্তুভিটায় অবৈধ জনতায় দলবদ্ধ হয়ে ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে নিহত হন রহিমা খাতুন। দু সন্তান, স্ত্রী-সন্তানেরাও আহত হন। প্রতিপক্ষরা তাদের জমি-জমা দখল করে নেয়। এ নিয়ে থানায় মামলা হয়।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা মৃত মায়ের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। এখানে জেনে নেয়া যাক সুরতহাল রিপোর্ট কি। ১৮৯৮ সালের প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৭৪ ধারা মোতাবেক কোন অপমৃত্যুর সংবাদের প্রেক্ষিতে পুলিশ অফিসার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সাক্ষীদের উপস্থিতিতে উক্ত মৃত ব্যক্তির পা হতে মাথা পর্যন্ত ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে যে কারণে তার মৃত্যু হয়েছে আপাতত দৃষ্টিতে উক্ত মৃত্যুর কারণ নির্নয় করার জন্য যে রিপোর্ট তৈরি করা হয় তাকে সুরতহাল রিপোর্ট বলে। (পিআরবি-২৯৯)।
সুরুতহাল প্রতিবেদনে মামলার বাদী ছাকু মিয়াসহ অনেকেই টিপসই দেন, কেউ কেউ দস্তখত করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয় মৃতা রহিমা খাতুনের বাম চোখের ভ্রুর উপর কাটা চিহ্ন, চোখের নিচের হাড় ভাঙ্গা, মাথার পিছনে আঘাত। আর ডান দিকের গালে একটি কালসিটে দাগ আছে। ময়না তদন্তের প্রতিবেদনেও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা তাই লিখেন। আর মৃত্যুর কারণ হিসেবে আঘাতের ধাক্কা ও রক্তক্ষরণের কথাই উল্লেখ করেন। কিন্তু সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরির ঠিক আধা ঘন্টা পূর্বে বাদী ছাকু মিয়া থানায় যে এজাহার দাখিল করেন তাতে বলা হয় যে মৃত ভিকটিমের ডান চোখের উপর কাটার দাগ। আসামীরা ধারাল অস্ত্র (বেকি) ও ছুরি দিয়ে মৃতা রহিমা খাতুনের ডান চোখের উপর, ডান বুকে ও মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করেছে।
এজাহারের গর্ভে বর্ণিত ভিকটিমের শরীরের ক্ষতের স্থান হল ডান চোখের উপর আর প্রকৃত জখম হল বাম চোখের উপর। এই অসঙ্গতি নিয়ে মামলার তদন্ত চলতে থাকে। তদন্ত শেষে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বিজ্ঞ আদালতে চার্জশীট দাখিল করেন। শুরু হয় বিচারিক কার্যক্রম। আদালত সাক্ষ্য প্রমাণ শেষে আসামীদের বেকসুর খালাস দেন। কিন্তু কেন?
অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম ও প্রধানতম কারণ ছিল মামলার এজাহারে বর্ণিত ভিকটিমের শরীরের আঘাতের স্থানের সাথে (ডান চোখের উপর) সুরতহাল ও ময়না তদন্তে বর্ণিত আঘাতের স্থানের (বাম চোখের উপর) গরমিল।
পাঠক, এখানে জেনে নেয়া যাক ময়নাতদন্ত কি। পোস্টমর্টেমকে বাংলায় বলা হয় ময়না তদন্ত। পোস্টমর্টেমের আরেকটি নাম রয়েছে, আর সেটি হচ্ছে ‘অটপসি’। সাধারণভাবে অটপসি হলো আইনানুগভাবে মৃতদেহ পরীক্ষা করে মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করা। কোনও ব্যক্তি কখন, কিভাবে, কোথায়, কিসের দ্বারা মৃত্যু বরণ করেছে বা তার মৃত্যু কি স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক এই সকল তথ্য জানার জন্য মৃতদেহকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্তৃক যে বিশেষ পরীক্ষা করা হয় তাকে পোস্টমর্টেম বা ময়না তদন্ত বলে ।
যেকোনও হত্যা মামলায় ময়নাতদন্ত রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি যথাযথ না হলে একটি হত্যা মামলা প্রমাণ করা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি অপরাধীদের ছাড়া পেয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। একইভাবে তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদন বা অভিযোগপত্রও মামলার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এই অভিযোগপত্রের ওপর ভিত্তি করেই মামলার বিচারকাজ পরিচালিত হয়।
একটি হত্যা সংঘটিত হওয়ার পর সেখানে প্রথমেই পুলিশ যায়। পুলিশ কর্মকর্তা গিয়েই লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেন। লাশটির শরীরে কেমন আঘাত, কোথায় আঘাত, চোখ, মুখ, নাক, চুল, মলদ্বার, লিঙ্গ এসবের অবস্থা তিনি যা দেখবেন, সেভাবেই বর্ণনা করবেন। এমনকি ক্ষত বা আঘাত মেপে তাও লিখবেন। ক্রাইমসিন আলামত সংগ্রহ করার পর সেই লাশ ময়নাতদন্তের জন্য যেকোনও অনুমোদিত হাসপাতলে পাঠাবেন। হাসপাতালের নির্ধারিত চিকিৎসক লাশ গ্রহণের সময় একটি বর্ণনা পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নেবেন। এরপর তিনি ময়নাতদন্ত করবেন। ভিসেরা সংগ্রহ করবেন। যেসব লাশের শরীরে দৃশ্যমান আঘাত থাকে সেগুলোর বিষয় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন চিকিৎসক। কিন্তু আঘাতের চিহ্ন নেই, এমন লাশের মৃত্যুর কারণ জানতে আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।
একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এজাহারে একটি হত্যা মামলায় যদি দু’টি ছুরিকাঘাতের কথা উল্লেখ থাকে, সুরতহালেও তা-ই লিখতে হবে। কিন্তু ময়নাতদন্তে যদি রিপোর্ট আসে যে, তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। তখন ওই মামলা প্রমাণের জন্য গলার ছাপ নিতে হবে। ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। তারপর জানা যাবে কে বা কারা হত্যা করেছে। এভাবেই মূলত প্রতিটি রিপোর্ট মামলায় প্রভাব ফেলে।
বিচারিক আদালত অত্যন্ত নিপুনভাবে সাক্ষ্য প্রমাণ ও উপস্থাপিত আলামত বিশ্লেষণ করে তার সিদ্ধান্ত টেনেছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই, যে পুলিশ কর্মকর্তা বাদীকে এজাহার লিখতে সহায়তা করেছেন, সেই কর্মকর্তাই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন। সেই পুলিশ অফিসারই পুরো মামলাটি তদন্ত করেছেন। কিন্তু এজাহার গ্রহণ থেকে শুরু করে অভিযোগপত্র দাখিল পর্যন্ত কোন পর্যায়েই ভিকটিমের শরীরের আঘাতের স্থান সংক্রান্ত গরমিলের সুরাহা করেননি। তার নিজের তৈরি সুরতহাল প্রতিবেদনে যেখানে বলছে মৃতার বাম চোখের উপর আঘাত তখনও তিনি এজাহারে বর্ণিত ডান চোখের উপরই ভর করে আছেন এবং অভিযোগপত্রেও ডান চোখের উপর আঘাতের কথাই লিখে গেছেন। তার অভিযোগপত্রের স্বপক্ষে সাক্ষীদের ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারা জবানবন্দীতেও একই ভাষ্য লিপিবদ্ধ করেছেন। মামলার তদন্ত ও বিচারিক পর্যায়ে সাক্ষীদের জবানবন্দীর নানা অসঙ্গতির মধ্যে প্রধানতম অসঙ্গতি ভিকটিমের চোখের আঘাতের ডান-বামের পাল্লায় পড়েই ‘সন্দেহের সুবিধা’ পুরো অংশই চলে গেছে আসামীদের পক্ষে। তাই তারা বেকসুর খালাস।
জেনে নেয়া যাক, কি কারনে বাদী পক্ষের মামলায় সন্দেহের সৃষ্টি হয়।
১) আসামির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাক্ষীর দ্বারা সমর্থিত না হলে সন্দেহের সৃষ্টি করে।
২) এজাহারের বিবরণ গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দ্বারা যদি সমর্থিত না হয়।
৩) আসামীর নিকট থেকে উদ্ধারের আলামত জব্দ তালিকার সাক্ষী দ্বারা প্রমাণিত না হলে।
৪) স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জব্দ তালিকার সাক্ষী না করলে। (ফৌজদারী কার্যবিধি-১০৩ ধারা)
৫) এজাহারের বিবরণ সমর্থন করে সাক্ষী জবানবন্দী প্রদান না করলে।
৬) জেরার উত্তর এজাহারের বিবরণ ও সাক্ষীর জবানবন্দী সমর্থন না করলে।
৭) আসামীর দাখিলীয় কাগজ পত্র বাদীর অভিযোগকে মিথ্যা প্রমান করলে।
উপরে উল্লেখিত কারণের কোন একটি যদি বাদী পক্ষের মামলায় পাওয়া যায় তাহলে মামলা নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হবে। আর এইরুপ সন্দেহের সুবিধা আসামীপক্ষ পাবার অধিকারী হয়, যার কারণে আসামী মামলা থেকে রেহাই বা অব্যাহতি অথবা খালাস পেতে পারে।
বাদীর মামলাটি রুজু, সুরতহাল তৈরি, তদন্ত ইত্যাদি নিয়ে কতটুকু অদক্ষতা প্রদর্শিত হয়েছে তা বলা মুসকিল। কিন্তু এ মামলার রায়ের কোথাও আদালতের দৃষ্টিতে তাকে অদক্ষতা বলা হয়নি। মামলার তদন্ত, আলাতম সংগ্রহ ও সাক্ষীদের উপস্থাপনসহ অন্যান্য কোন ক্ষেত্রেই পুলিশের কোন গাফিলতি সম্পর্কি কোন মন্তব্য বা পর্যবেক্ষণ মামলার রায়ে নেই।
বাদী এ খালাস আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করতে চাইলে বিজ্ঞ পিপি তাতে সাড়া দেননি। সেকারণ, বাদী নিজ খরচে আপীল করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও ব্যর্থ হয়। বিচারে কাঙ্খিত ফলাফল না পাওয়ার বেদনায় মর্মাহত বাদী ছাকু মিয়ার বিশ্বাস, জগতের সবাই তাদের প্রতারণা করেছে। তাদের মৃতা মা রহিমা খাতুনের আঘাত অবশ্যই ডান চোখের উপর। এজাহারে তারা ঠিকই লিখেছিলেন। সাক্ষেও তারা একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু পুলিশ ও ডাক্তার টাকা খেয়ে ওটা ডানের পরিবর্তে বাম দিকে লিখে দিয়েছে। তার দাবী টাকার জোরে সব হয়। তারা গরীব বলেই ন্যায় বিচার পেলেন না। আর আসামীরা এতটাই প্রভাবশালী বা অর্থশালী যে তাদের ভয়ে কোন উকিল মামলাটি আপিলের জন্যও গ্রহণ করছেন না।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার উপর এরকম হাজারও পরিবারের বিশ্বাসের চিড় ধরেছে।
গত ৬ আগস্ট ২০১৭ বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের রায় ঘোষণার সময় হাইকোর্টের বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর বেঞ্চ মরদেহের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী পুলিশ সদস্য ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কারণ, বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকা-ের ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের কোনও মিল ছিল না। ভিডিও ফুটেজ ও সাক্ষীদের বর্ণনা অনুসারে বিশ্বজিতের শরীরে রড, লাঠি ও ধারালো অস্ত্রের একাধিক আঘাতের কথা থাকলেও মামলায় দাখিল করা সুরতহাল প্রতিবেদন ও ময়নাতদন্ত রিপোর্টে এত আঘাতের তথ্য ছিল না। তাই বিষয়টিতে দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা- তা খতিয়ে দেখতে আদালত আদেশ দেন।
প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘উচ্চ আদালতের সকল আদেশ নিষেধ যথাযথভাবে পলিত হয়েছে।’ সেদিন আমাদের সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।