স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে সুখের সংসার ছিল প্রিয়া খাতুনের। খুলনায় সুন্দরবনের কোলঘেঁষা শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর সঙ্গে থাকতেন তিনি। হঠাৎ করেই তার জীবনে নেমে আসে ভয়ঙ্কর যৌতুকের থাবা। প্রিয়ার কাছে তার স্বামী যৌতুক দাবি করে। বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে না পারায় ঘুমন্ত অবস্থায় তার শরীরে এসিড ছুঁড়ে মারে স্বামী। শুধু প্রিয়া নয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যৌতুকের আগুনে দগ্ধ হয়ে প্রায়ই নারীরা ভর্তি হন। দুর্ভাগা এই নারীদের কেউ কেউ মৃত্যুর কাছে হেরে যান। কেউবা কিন্তু দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকেন। এ অবস্থার পরিবর্তনে যৌতুক নিয়ন্ত্রণ আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, এই সেন্টারটি চালু হওয়ার পর থেকে এপ্রিল ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢামেকে আগুন সন্ত্রাসের শিকার হয়ে দগ্ধ অবস্থায় ভর্তি হন ২৬২ জন নারী। আর সারাদেশে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে শারীরিক,যৌন ও আগুন সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৩২ হাজার ৭৭৭ জন নারী।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধের শিকার হয়েছেন ৮ জন নারী। এরমধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২১ জন। এরমধ্যে ৯ জনকে যৌতুকের জন্য হত্যা করা হয়।
এসিডদগ্ধ প্রিয়া জানান, প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে পরে ঢামেকের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন তিনি। তার গলা থেকে নাভি পর্যন্ত পুরোটাই এসিডে পুড়ে গেছে। ব্যান্ডেজ অবস্থায় অসহ্য যন্ত্রণা আর কষ্টের মধ্য দিয়ে কাটছে তার দিন। তিনি জানান, হাসপাতালে ভর্তির পর স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কেউই তাকে দেখতে আসেনি। ঢামেকের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে প্রিয়ার মতো সেবা নিতে আসা অনেকেই আছেন, যারা যৌতুকের লোভের শিকার হয়েছেন। তাদের অনেকেই জানান, আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির কেউই দেখতে আসে না।
প্রিয়ার মা আসমা খাতুন বলেন, ‘আমাদের তিন মেয়ে। প্রিয়া সবার বড়। ওর বাবা পাতা বিক্রি করে সংসার চালান। এখন আমি আর আমার বাবা (প্রিয়ার নানা) হাসপাতালে থেকে মেয়েকে চিকিৎসা করাচ্ছি।’
প্রিয়ার বাবার বাড়ি যশোরে। স্বামী নাজমুলের বাড়ি খুলনায়। আসমা খাতুন বলেন, ‘হাসপাতালে ভর্তির পর থেকে জামাই নাজমুল মেয়ের (প্রিয়া) চিকিৎসার কোনও খরচই দিচ্ছে না। একবারের জন্য দেখতেও আসে না। যশোর থেকে ঢাকা পর্যন্ত আসলাম, একটা টাকাও দেয়নি। আমরা গরিব মানুষ, কী করে চিকিৎসা চালাবো। নিজের মেয়েকে তো ফেলে দিতে পারি না।’
তিনি বলেন, ‘বিয়ের সময় জামাই কোনও টাকা নেয়নি। পরে মেয়েকে মারধর শুরু করে এবং টাকা চায়। আমরা গরিব মানুষ, টাকা দিতে পারিনি। ’
হাসপাতালের বিছানায় বসে প্রিয়া খাতুন বলেন, ‘ও (স্বামী) আমার চিকিৎসার টাকা দিতে চায়। ওর মা-বাবা টাকা দিতে চাচ্ছে না। এখানে আমাদের অনেক খরচ হচ্ছে। ওষুধ কেনা লাগে। খাবার কেনা লাগে। রক্ত দিতে হয়, মিলে না। সব মিলিয়ে কষ্টে আছি।’ তিনি বলেন ‘আমি পাঁচ মাসের প্রেগন্যান্ট। ভবিষ্যতে কী হবে বুঝতে পারি না। ’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘এটা একটা বিরাট সমস্যা। আমি আমার জীবনে অনেক দেখেছি। যৌতুকের দাবিতে গাছের সঙ্গে বেঁধে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কিংবা প্রেগন্যান্ট অবস্থায় এখানে এসে মারা গেছে। এরকম বহু রোগী আমি পেয়েছি। অনেকে বেঁচে গেছেন। তাদের স্বামী ছেড়ে দিয়েছে। তারা এখন রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ান। এটা খুবই বার্নিং প্রবলেম আমাদের জন্য। এটা খুবই কমন। ’
ঢামেকে একই বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. পার্থ শংকর পাল বলেন, ‘আমাদের এখানে যৌতুকের কারণে পুড়িয়ে দেওয়া প্রচুর রোগী আসেন, তবে সেভাবে আমরা ডাটা সংগ্রহ করি না। লোকবলের অভাবে সেটা করা সম্ভব হয় না। তবে, এই ধরনের প্রচুর রোগী আমরা পাই।’
বার্ন ইউনিটের গ্রিন ওয়ার্ডের দায়িত্বরত স্টাফ নার্স পিংকি বলেন, ‘আমার এই ওয়ার্ডে এখন যৌতুকের শিকার কোনও নারী ভর্তি নেই। তবে এ ধরনের রোগী আমরা প্রায়ই পাই। এটা খুবই কষ্টকর। নিজের স্বামী সামান্য কয়টা টাকার জন্য স্ত্রীকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ঢাকা মহানগর কমিটির যুগ্ম সম্পাদক মঞ্জু ধর বলেন, ‘দেশে যৌতুকবিরোধী আইন আছে। কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কঠোর শাস্তি হচ্ছে না। বর্তমানে যে আইনটি আছে, সেটার চেয়ে আরও কঠোরভাবে আইন করা দরকার। আগে যৌতুকের কারণে যে নির্যাতন ছিল, তার চেয়ে এখন বেশি হচ্ছে। এখন মানুষের মনমানসিকতা বেশি পরিবর্তন হয়েছে। আগে মানুষের প্রতি সহানুভূতি ছিল, এখন সেটা নেই। যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া দুটোই অপরাধ। তারপরও টাকার প্রতি মানুষের লোভ বেড়ে গেছে। সবকিছুর বিনিময়েই টাকা চাই। যেকোনও সময়েই টাকার জন্য দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। কেউ যৌতুকের কারণে নির্যাতন করে ধরা পড়লে কিছুদিন জেলে থাকে, পরে বের হয়ে যায়। সেই কারণে সমাজে সহিংসতা বেশি হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আগেও যৌতুক প্রথা ছিল। কিন্তু সেটার জন্য এত বেশি নির্যাতন ছিল না। এখন আমরা যৌতুকের বিরুদ্ধে লড়ছি। কিন্তু এটা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হচ্ছি না। সমাজ থেকে যৌতুকের সহিংসতা দূর করতে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
/ বাংলা ট্রিবিউন)