‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মৃত্যু, নাকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড-এর বিহিত চেয়ে ভুক্তভোগী পরিবার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো উচ্চ আদালতে তিনটি রিট করেছে। আদালতও স্বপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রের কাছে জবাব চেয়েছেন। কিন্তু গত এক যুগেও রাষ্ট্র কোনো জবাব দেয়নি।
২০০৬ সালে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় ক্রসফায়ারে নিহত টুন্ডা ইসমাইলের ভাই প্রথম রিটটি করেন। ওই বছরই হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ ৫০০টি ঘটনা নিয়ে দ্বিতীয় রিটটি করে। ২০০৯ সালের জুন মাসে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও কর্মজীবী নারী র্যাবের বিরুদ্ধে ৫২৭টি ও পুলিশের বিরুদ্ধে ৪৪২টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ এনে আরেকটি রিট করে। ২০০৯ সালের নভেম্বরে আরেক ঘটনায় উচ্চ আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। ২৬টি ঘটনার তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন দিয়ে এবার আদালতের পক্ষভুক্ত হয় আসক ও ব্লাস্ট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনটি রিটের ক্ষেত্রেই শুনানি শুরুর পর আদালতের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ ভেঙে দেওয়া হয়। বিচারকাজ সেখানেই থেমে আছে।
বিচারকাজ থেমে থাকলেও ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ থামেনি। ২০০৪ সালে র্যাব গঠনের পর গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত র্যাব-পুলিশের ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধে ২ হাজার ২৯২ জন নিহত হয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে বরাবর একই ধরনের বিবৃতি সংবাদমাধ্যমকে দিয়ে আসছে। এমনকি টেকনাফের যুবলীগ নেতা একরামুল হক নিহত হওয়ার পরও সংবাদমাধ্যমে র্যাবের পাঠানো বিবৃতি ছিল আগের যেকোনো ঘটনার মতোই।
স্বপ্রণোদিত রুলও চাপা পড়ে গেছে
২০০৯ সালের ১৫ নভেম্বর বাবলু খালাসী মাদারীপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তাঁর বাবা লুৎফর খালাসী ও চাচা খায়রুল খালাসীকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হতে পারে। এক দিন পর ১৬ নভেম্বর ভোররাতে মাদারীপুর সদরের শিরখাড়ার স্লুইসগেট এলাকায় ক্রসফায়ারে নিহত হন তাঁরা। পরিবারের অভিযোগ, তাঁদের ১৩ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের মাসুম কলোনি থেকে র্যাব-৩ তুলে নিয়ে র্যাব-৮-এ হস্তান্তর করে। আগেও এই পরিবারের এক সদস্য ক্রসফায়ারে নিহত হন।
আদালত ওই ঘটনায় স্বপ্রণোদিত হয়ে তৎকালীন মেজর কাজী ওয়াহিদুজ্জামান, র্যাব-৮-এর ক্যাম্প ইনচার্জ লেফটেন্যান্ট হাসান, র্যাবের মহাপরিচালক ও স্বরাষ্ট্রসচিবের প্রতি রুল জারি করেন এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে লুৎফর খালাসী ও খায়রুল খালাসীকে হত্যায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, সরকারের কাছে তা জানতে চান।
আদালত বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণের পরও সরকারের প্রতি আনুগত্যের ছলে এ জঘন্য কর্মকাণ্ড চলছে, যা মূলত সরকারের ভাবমূর্তিকেই নষ্ট করছে বলে মনে করে নাগরিক সমাজ। এ ধরনের কিছু লোক আসলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে নির্যাতনের মাধ্যমে সরকারেরই মানহানি করছে।’
র্যাব জানায়, রুলে যে র্যাব সদস্যদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের একজনের অস্তিত্বই নেই।
আদালতের এই রুলে পক্ষভুক্ত হয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র। তারা লুৎফরসহ ১৪টি ঘটনার উল্লেখ করে। ব্লাস্টও পক্ষভুক্ত হয়ে বিচারবহির্ভূত এক ডজন খুনের উল্লেখ করে। এই তালিকায় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক গুরু মোফাখখার চৌধুরীর ক্রসফায়ারে হত্যার উল্লেখ আছে।
এত কিছুর পরও মাদারীপুরের লুৎফর খালাসী ও খায়রুল খালাসী ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছিলেন নাকি ‘খুন’ হয়েছিলেন, সে সম্পর্কে কিছু জানা গেল না। ২০০৯ সালের ২৩ নভেম্বর আদালত ওই দুই ভাইকে আটকে র্যাবের কারা জড়িত ছিলেন, তা ৯ ডিসেম্বরের মধ্যে জানাতে র্যাবের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেন। ১৪ ডিসেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন রাষ্ট্রপক্ষ আরও সময় প্রার্থনা করে। আদালত ১১ জানুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন এবং চূড়ান্ত শুনানির আগে পর্যন্ত ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টার বন্ধের নির্দেশ দেন। পরবর্তী শুনানির চার দিন আগে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চটি ভেঙে দেওয়া হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকারকে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত; সরকার দেয়নি। আমরা চাই রিটের শুনানি হোক। ন্যায়বিচারের স্বার্থে এটা প্রয়োজন।’
জানতে চাইলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রিট আবেদন যাঁরা করেছেন, এর খোঁজখবর করাটা তাঁদের দায়িত্ব। কেন রিটের অগ্রগতি নেই, তা তাঁরাই বলবেন।
অন্য রিটগুলোর অবস্থাও একই
২০০৬ সালের ২২ মে রাজধানীর লালবাগ থানায় রিমান্ডে থাকা আসামি ইসমাইল হোসেন ওরফে টুন্ডা ইসমাইল (৩৫) পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় পুলিশের ক্রসফায়ারে নিহত হন। ২৫ মে টুন্ডার বড় ভাই শাহ আলম একটি রিট আবেদন করেন। আদালত রুল জারি করেছিলেন সংক্ষিপ্ত শুনানির পরই। যে বেঞ্চ রুল জারি করেন, তা-ও ভেঙে যায়।
২০০৬ সালে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ উচ্চ আদালতে রিট করে। তাতে কমপক্ষে ৫০০ ব্যক্তির বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে। আদালত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, র্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ও পুলিশের মহাপরিদর্শক বরাবর জানতে চান, হেফাজতে থাকা বা আটক ব্যক্তিদের কেন নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে না। তিন সপ্তাহের মধ্যে জবাব চান আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি। ২০০৯ সালের ৫ জুলাই অন্য একটি বেঞ্চে শুনানির কথা ছিল। কিন্তু সে শুনানি আর হয়নি।
২০০৯ সালের জুন মাসে দ্বিতীয় রিটটি করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট ও কর্মজীবী নারী। ওই রিটে তারা র্যাবের বিরুদ্ধ ৫২৭টি ও পুলিশের বিরুদ্ধে ৪৪২টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনে। ৭ জুলাই আদালত রাষ্ট্রপক্ষকে ছয় দিনের মধ্যে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেন। ১০ জুলাই রাষ্ট্রপক্ষ শুনানি মুলতবির আবেদন করে। আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শিপা হাফিজা বলেন, অপরাধের বিচার না হওয়ায় স্বার্থান্বেষী মহল ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে অপরাধে জড়ায়। এর মধ্যে রাষ্ট্র যদি নিজেই ফাঁকফোকর বের করে দেয়, তখন এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়তে থাকে। প্রথম আলো