সুদীপ দাশ। জন্ম থেকেই এক চোখে দেখতে পান না। পরবর্তীতে নষ্ট হয়ে গেছে দ্বিতীয় চোখটিও। তবে, এই প্রতিবন্ধকতা দমিয়ে রাখতে পারেনি তাকে। সব বাধা পেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন তিনি। স্বপ্ন দেখেন বিচারক হবার। আইন বিভাগ থেকে পাস করলেও দেশের আইনই তার স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একাধিকবার জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের (বিজেএসসি) নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আবেদন করলেও শেষ পর্যন্ত প্রচলিত আইনের কারণে শ্রুতিলেখক না পেয়ে হল থেকে বেরিয়ে এসেছেন হতাশা নিয়ে।
রেলওয়ে কর্মকর্তা প্রদীপ চন্দ্র দাশ ও স্কুল শিক্ষক মিরা দাশের দ্বিতীয় সন্তান সুদীপ ২০০৭ সালে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। ক্ষীণদৃষ্টি হওয়ায় চোখের খুব কাছে বই নিয়ে পড়তে হতো তাকে। চলাফেরার সময় সঙ্গে কাউকে না কাউকে রাখতেই হতো। সহপাঠী ও শিক্ষকদের সহযোগিতায় স্কুলের গণ্ডি পার হলেও ভর্তি পরীক্ষার আগে হঠাৎ করেই তার দ্বিতীয় চোখটিও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মানুযায়ী ভাইভা দিয়েই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা তাকে পড়া রেকর্ড করে দিতেন এবং সব পরীক্ষায় শ্রুতিলেখক নিয়েই পরীক্ষা দিয়েছেন তিনি।
দু’চোখে আলো না থাকলেও জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ার প্রতি ছিল তার তীব্র আগ্রহ। ক্ষীণদৃষ্টি হওয়ার কারণে ১০০ ওয়াটের টেবিল ল্যাম্প চোখের সামনে নিয়ে লেখাপড়া করতেন। বাল্বের প্রচণ্ড তাপে মাথা গরম হয়ে যেত। মাথায় খুব যন্ত্রণা করত। তবুও লেখাপড়া থামাননি।
২০১৫ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর ১১তম সহকারী জজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন সুদীপ। পরীক্ষার আগে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করে একজন শ্রুতিলেখকের অনুমতির জন্য বিজেএসসিতে যান। তবে, সেখান থেকে তাকে বলা হয়, এই পরীক্ষায় প্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণের সুযোগ নেই।
কিন্তু এতে থেমে যাননি সুদীপ। আবেদন করেন ১২তম সহকারী জজ নিয়োগের পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। এবারও সুদীপ একজন শ্রুতিলেখকের জন্য আবেদন করেন। মৌখিকভাবে তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের পক্ষ থেকে। তবে শ্রুতিলেখক পাওয়ায় আবেদন বাতিল হলেও নীরব প্রতিবাদ স্বরূপ শুক্রবার নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন সুদীপ।
এদিকে সুদীপের শ্রুতিলেখকের আবেদন নাকচের কারণ হিসেবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন থেকে জানানো হয় দেশের প্রচলিত দুটি আইন। সার্কুলারের ছয় নম্বর অনুচ্ছেদের ১৩ ও ২০ নম্বর ধারা এবং ২০০৭ সালে হওয়া বিচারবিভাগ পৃথকীকরণ আইনের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদে এই নিয়োগে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকার বিষয়টির উল্লেখ রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) -এর রিসার্স স্পেশালিস্ট অ্যাডভোকেট মোঃ রেজাউল করিম সিদ্দিকীর কাছে জানতে চাইলে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কমকে জানান, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সুরক্ষা আইন, ২০১৩ এর ধারা ১৬(১) (ঝ) মোতাবেক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিয়োগ লাভ প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নাগরিক অধিকার। এই আইন অনুযায়ী এই অধিকার বাস্তবায়নে নিয়োগ পরীক্ষা থেকে কর্মে নিযুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত সকল প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে চাকরীতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনও বাধ্য।
অ্যাডভোকেট মোঃ রেজাউল করিম সিদ্দিকী আরও বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী চাকুরিপ্রার্থীকে কেবলমাত্র তার প্রতিবন্ধিতার কারণে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া বা এরূপ প্রতিবন্ধকতা আরোপকারী আইনসমূহ নাগরিকের সমতার অধিকার লাভের পরিপন্থী এবং একই সাথে সংবিধানের অনুচ্ছেদ- ২৭, ২৮ ও ২৯ এ প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির কার্যকরী পরিষদের সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট কুমার দেবুল দে ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডট কমকে জানান, একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সে একজন ছাত্র হওয়া, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পাস করে যদি একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, উকিল বা অন্য যে কোন পেশায় নিযুক্ত হতে পারেন তবে বিচারক হতে বাধা কোথায়?
আইনজীবী কুমার দেবুল দে বলেন, বিচারিক প্রক্রিয়াতে একজন বিচারক মূলত শুনানি গ্রহণ করেন। ফলে একজন বিচারকের শুনানি গ্রহণের শারীরিক সক্ষমতা থাকাই যথেষ্ট। কেননা, বিচারকের রায় বা আদেশ লেখা, রায় বহন, এজলাসে বসিয়ে দেওয়াসহ বিচারিক পোশাক পরিয়ে দেওয়ার জন্য লোক থাকে।
(আদালত.টিভির সৌজন্যে সুদীপের বক্তব্য শুনুন ভিডিওতে)
[youtube https://www.youtube.com/watch?v=ZrWzRehXOY4]