অনলাইনে কর আদায়ের বিধান রেখে নতুন ‘আয়কর আইন’-এর খসড়া প্রস্তুতির কাজ চলছে। এতে ইটিআইএন, ই-রিটার্ন দাখিল, ই-পেমেন্ট, ই-ফাইলিংসহ একগুচ্ছ পদক্ষেপ থাকছে। নতুন আইনের খসড়ায় রাজস্ব ফাঁকিবাজদের জেল, জরিমানা, হিসাব জব্দ, সম্পত্তি জব্দসহ বিভিন্ন শাস্তির বিধান থাকছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ের সব আইন যুগোপযোগী করতে প্রস্তুতি চলছে। এতে রাজস্ব আদায়ে আধুনিকতা আসবে। করদাতাদের হয়রানি কমবে। তারা রাজস্ব পরিশোধে আগ্রহী হবে। ফলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়বে।’
এনবিআর সূত্র জানায়, আইনের খড়সায় বড় মাপের ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রতি কঠোর নজরদারির নির্দেশনা থাকছে। কর্মকর্তাদের আয়-ব্যয়ের তথ্য গোপন করা হলে তার জন্য প্রতিষ্ঠানের মালিকদের জবাবদিহির নিয়ম রাখা হয়েছে। এ ছাড়া করযোগ্য না হলেও এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের প্রত্যেকের ইটিআইএন গ্রহণ বাধ্যতামূলক করতে বিধান আছে। করযোগ্য আয় থাকলে বাধ্যতামূলক ই-রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের কেউ আয়কর রিটার্নে মিথ্যা তথ্য ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করার কথা আইনের খসড়ায় রাখা হয়েছে।
আয়-ব্যয়ের তথ্য যাচাইয়ে সরকারি কর্মচারীদের সমান নজরদারি করা হবে তাদের স্ত্রী বা স্বামী ও সন্তানদের আয়-ব্যয়ের হিসাব। সারচার্জ বহাল রাখা হবে। নতুন আয়কর আইনের খসড়ায় সুপার ট্যাক্স গ্রুপ হিসেবে সম্পদশালীদের চিহ্নিত করে আয়কর আদায়ের পরিমাণ নির্ধারণ করা থাকবে।
নতুন আয়কর আইনের খসড়ায় বাড়িওয়ালাদের আদায়কৃত ভাড়া থেকে হিসাব কষে রাজস্ব আদায়ে বিধান রাখা হচ্ছে। ২৫ হাজার টাকার বেশি ভাড়া আদায়ে পৃথক ব্যাংক হিসাব খুলে ভাড়া আদায়ের কথা আছে।
৫০ লাখ টাকা বা এর বেশি পরিমাণে আয়কর বকেয়া থাকলে এনবিআর থেকে এক বছরে তিনবারের বেশি সময় দেওয়ার পরও পরিশোধ না করলে জেল, জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কত দিনের জেল ও কী পরিমাণ জরিমানা হবে তা নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে।
নতুন আয়কর আইনের খসড়ায় করদাতাদের আয়-ব্যয়, স্থাবর, অস্থাবর সম্পদের হিসাবসহ আয়কর রিটার্নের তথ্য এনবিআরের কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে গচ্ছিত রাখার নির্দেশনা থাকবে। রাজস্ব ফাঁকির তথ্য যাচাইয়ে এনবিআর সংশ্লিষ্টরা প্রয়োজনে তথ্য ভাণ্ডার থেকে এসব তথ্য খতিয়ে দেখার সুযোগ পাবেন। বিশেষভাবে আয়কর রিটার্নে দেওয়া এক বছরের তথ্যের সঙ্গে পরের বছরের তথ্য সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না তা মিলিয়ে দেখার সুযোগ থাকবে।
রাজস্ব জালের সম্প্রসারণে নতুন আয়কর আইনের খসড়ায় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলার জন্য বিশেষ কোড থাকবে। কোন করদাতা কোন উপজেলায় আছে তা এ কোডের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হবে। অর্থাৎ করদাতার ইটিআইএনের সঙ্গে উপজেলা কোড উল্লেখ থাকার কথা আয়কর আইনের খসড়ায় আছে।
নতুন আইনের খসড়ায় ধার্যকৃত আয়করের হার ন্যূনতম তিন বছরের মধ্যে অপরিবর্তিত রাখার বিধান রাখা হয়েছে। করমুক্ত আয়সীমা নির্দিষ্টহারে নির্ধারণ করা থাকবে, যা ন্যূনতম তিন বছরের মধ্যে পরিবর্তনের সুযোগ থাকবে না।
নতুন আয়কর আইনের খসড়া অনুযায়ী বকেয়া কর আদায়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের তিন খাতের মধ্যে চলতি এবং গত কয়েক অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা সবচেয়ে বেশি নির্ধারণ করা হয়। তবে আয়কর আদায়েও প্রায় সমান গুরুত্ব দিয়েছে সরকার। ভ্যাটের থেকে সামান্য কমিয়ে আয়কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়। গত অর্থবছরে ভ্যাট আদায়ে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮২ হাজার ৭১৩ কোটি টাকা এবং চলতিবারে এক লাখ ১০ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা ধার্য করা হয়। ভ্যাটের চেয়ে সামান্য কমিয়ে আয়করে গতবারের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৭৭ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা এবং চলতিবারে এক লাখ ৭১৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে আমদানি-রপ্তানি পর্যায়ে (শুল্ক খাতে) সবচেয়ে কম ২৮.৭৬ শতাংশ আদায় হলেও স্থানীয় পর্যায়ে মূসক খাতে ৩৬.০৭ শতাংশ এবং আয়কর ও অন্যান্য খাতে ৩৫.১৭ শতাংশ আদায় হয়েছে।
বর্তমানে ইটিআইএনধারীর সংখ্যা ৩৬ লাখ ছাড়িয়ে গেলেও গত কয়েক বছরে রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা গড়ে ১৮ লাখ।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আয়কর খাতে রাজস্ব আদায় বাড়াতে সাধারণ মানুষকে রাজস্ব পরিশোধে উৎসাহিত করতে হবে। কর পরিশোধের হয়রানি কমতে হবে। নতুন আয়কর আইনে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এ ছাড়া রাজস্ব জালের সম্প্রসারণেও জোর দিতে হবে। এতে করদাতা ও রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা বাড়বে।’
তিনি আরো বলেন, ‘শুধু আইন করলেই হবে না বাস্তবায়নে কঠোরতা আনতে হবে।’ সূত্র : কালের কণ্ঠ