সরকারবিরোধী প্রপাগান্ডা ও ফেক নিউজ ঠেকাতে ‘নামসর্বস্ব’ অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে পুলিশ। ইতোমধ্যে প্রায় অর্ধশত নামসর্বস্ব অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের পক্ষ থেকে নামসর্বস্ব অনলাইন নিউজ পোর্টালের তালিকা করা হয়েছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত সব অনলাইন নিউজ পোর্টালের তালিকা ওয়েবসাইটে প্রকাশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তালিকা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে ‘নামসর্বস্ব’ শয়ে শয়ে অনলাইন নিউজ পোর্টাল রয়েছে। এগুলোর কাজই হলো প্রপাগান্ডা ছড়ানো। তারা অ্যান্টিএস্টেট প্রপাগান্ডা ও ফেক নিউজ ছড়িয়ে বেড়ায়। একটা-দুটো কম্পিউটার বসিয়ে পেশাদার অনলাইন পত্রিকাগুলোর নিউজ নকল করে চটকদার হেডিং দিয়ে প্রকাশ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেসব প্রমোট করে। ফলে অনেক সময় সাধারণ মানুষ না বুঝেই সেসব খবর বিশ্বাস করে বিভ্রান্ত হয়।
ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার মো. আলিমুজ্জামান বলেন, ‘যারা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের কোনও ভাষ্য নেই। কিন্তু যারা প্রপাগান্ডা ছড়ায় এবং ফেক নিউজ প্রকাশ করে তাদের শনাক্ত আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
আলিমুজ্জামান বলেন, ‘সাধারণ মানুষ বা পাঠকদের কাছে আমার অনুরোধ, প্রপাগান্ডা বা ফেক নিউজ বিশ্বাস করবেন না। দেখে-শুনে মূলধারার বা পোশাদারি ও প্রতিষ্ঠিত অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর খবর বিশ্বাস করুন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৮ অক্টোবার ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের পক্ষে ‘অনলাইন নিউজ পোর্টাল-এর মাধ্যমে মিথ্যা, বানোয়াট, গুজব ও প্রপাগান্ডামূলক সংবাদ প্রচার প্রসঙ্গে’ একটি চিঠি তথ্য মন্ত্রণালয় বরাবর পাঠানো হয়। এতে বলা হয়, অনলাইন নিউজ পোর্টালের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাইবার স্পেসে অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা বাড়ছে। অনেক পোর্টাল থেকে মিথ্যা, বানোয়াট, সাম্প্রদায়িক ও রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন প্রপাগান্ডামূলক সংবাদ পরিবেশন করা হয়। এসব সংবাদ সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরালও হচ্ছে। এ ধরনের সংবাদ দ্রুত সাধারণ জনগণের কাছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৌঁছায়, যা জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
ওই চিঠিতে অনলাইন খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা পোর্টালের লিস্ট মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ইউনিটের কাছে পাঠানোরও অনুরোধ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তথ্য মন্ত্রণালয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ১০০ অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু এর বাইরেও অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালু রয়েছে।
ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি তারা রিপোর্টবিডি টোয়েন্টিফোর ডটকম (reportbd24.com), অনলাইনবার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকম (onlinebarta24.com) ও টুডেনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম (todaynews24.com) নামে তিনটি অনলাইন বন্ধ করে দিয়েছে। এসব পোর্টালের সঙ্গে সম্পৃক্ত আবুল হাসান, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও শাওন আহমেদ নামে তিনজনকে আটক করা হয়। পরে রাজধানীর রমনা থানায় ডিজিটাল সুরক্ষা আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলার দায়েরের পর তিনদিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতার হওয়া তিনজনই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটি করে কম্পিউটার ব্যবহার করে তারা অনলাইন নিউজ পোর্টাল চালাতো। সংবাদ সংগ্রহের জন্য রিপোর্টার কিংবা সম্পাদনার জন্য কোনও কর্মী ছিল না।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান, সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া আবুল হাসান ফেসবুকে ৪০টি পেইজ পরিচালনা করতো। ফেক নিউজগুলো ফেসুবকের এসব পেইজে নিয়মিত শেয়ার করতো সে।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের দায়িত্বশীল ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত প্রায় অর্ধশত নামসর্বস্ব অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করতে পেরেছি। এরকম আরও অনেক নিউজ পোর্টাল রয়েছে। অনেকগুলো নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সহজলভ্য হওয়ায় মানুষ এখন ইন্টারনেটভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংবাদের দিকে ঝুঁকছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমেই বেশিরভাগ মানুষ দিনের আলোচিত ঘটনা জানতে পারে। এর সুযোগ নিয়ে কিছু অপেশাদার ব্যক্তি ডোমেইন ও হোস্টিং কিনে অনলাইন পোর্টাল তৈরি করছেন। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এসব অনলাইন একদিকে যেমন পাঠকের কাছে কোনও দায়বদ্ধতার তোয়াক্কা করছে না, তেমনি নামস্বর্বস্ব অনলাইনের নাম ব্যবহার করে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে কলুষিত করছে। এজন্য প্রতিটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিচে নিজেদের বিস্তারিত পরিচয় দেওয়া বাধ্যতামূলক করার আহ্বান জানিয়েছেন অনেকে।
জানতে চাইলে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আজকাল অনলাইন পত্রিকার নাম দিয়ে বহু নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে, যেগুলো সাংবাদিকতার নামে ভুঁইফোর প্রতিষ্ঠান। এগুলো সাংবাদিক সমাজকে বিতর্কিত করছে। এসব কারণে অনেক ক্ষেত্রে পেশাদার সাংবাদিকদের প্রশ্নবিদ্ধ হতে হচ্ছে।’
সোহেল হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘যে কেউ সাংবাদিকতার মতো মহৎ পেশায় আসতে চাইলে সেটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের দেখা উচিত। আরেকটি বিষয় হলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পেশাদার সংবাদ প্রতিষ্ঠানকে যেমন সুরক্ষা দেবে, তেমনি অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধেও তাদের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
হোস্টিং ক্যাপাসিটি বাড়ানোর সুপারিশ বিটিআরসিকে
ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ বিভিন্ন ওয়েবসাইটের হোস্টিং দিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর পাশাপাশি নজরদারি ও ফিল্টারিং করার জন্য বিটিআরসিকে তাদের ক্যাপাসিটি বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। বিটিআরসিকে দেওয়া এক চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশীয় ওয়েবসাইটগুলো বিদেশ থেকে সরাসরি হোস্টিং কিনছে। এর ফলে তাদের সহজে নজরদারিও যেমন করা যাচ্ছে না, তেমনি প্রচুর দেশীয় মুদ্রা অবৈধভাবে বিদেশে চলে যাচ্ছে।
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, বিটিআরসির মাধ্যমে হোস্টিং সরবরাহ করলে যেকোনও ওয়েবসাইট সম্পর্কে সহজেই জানা যাবে। কেউ যদি প্রপগান্ডা বা ফেক নিউজ ছড়ায় তাহলে তাকে দ্রুত নজরদারির মধ্যে আনা যাবে।