অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মশিউর রহমান:
অনেকসময় দেখা যায়, বাবা বা মায়ের কোলে চড়ে নাবালক শিশু আদালতে হাজিরা দিতে এসেছে, শিশুটির নামে মামলা হয়েছে, চার্জশিটে তার নাম উল্লেখ রয়েছে এমনকি তার নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। শিশুটি এসব বুঝতে না পারলেও মা-বাবার এতে বিস্ময় জাগে। পাশাপাশি সাধারন নাগরিকের মনেও এ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। নাবালক শিশুটি এক সময় বড় হলে অতীত স্মৃতির কথা মনে করে তার মনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। শিশুদের জন্য আইনে নির্দিষ্ট করে তাদের বিচারপদ্ধতি, কারানিবাস এবং শাস্তির কথা বলা আছে। শিশুদের প্রতি নমনীয় এবং সংশোধনমূলক বিচারের বিধান হিসেবে ১৯৭৪ সালে পাস হয় শিশু আইন। এ আইনে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়।
শিশুর বিচার পদ্ধতি
শিশুর বিচার পদ্ধতি পরিচালনার জন্য সরকার কোন স্থানীয় এলাকার জন্য এক বা একাধিক শিশুআদালত প্রতিষ্ঠাকরতে পারবে। এ আইনে শিশু এবং প্রাপ্ত বয়স্কদের একসঙ্গে বিচার করা চলবেনা। কোন শিশুপ্রাপ্ত বয়স্কের সঙ্গে একত্রে অভিযুক্ত হলে ওই অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণকারী আদালতের মামলাটি দায়রা আদালতে প্রেরণের উপযুক্ত হলে, আদালত মামলাটির শিশু সম্পর্কিত অংশ আলাদা করে স্থানীয় শিশু বা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বদলি করবেন এবং বাকী প্রাপ্তবয়স্ক সংশ্লিষ্ট দায়রা আদালতে প্রেরণ করবেন। তবে শিশু সম্পর্কিত মামলাটি শুধু দায়রাআদালত কর্তৃক বিচারযোগ্য হলে তা দায়রা আদালতে বদলি করা হবে। এভাবে শিশু এং প্রাপ্ত বয়স্কদের বিচার আলাদাভাবে সম্পন্ন করা হয়।
শিশু আদালতের এজলাসে বিচারচলাকালে যে কেউ উপস্থিত থাকতে পারবেন না। শুধু আদালতের সদস্যরা, অফিসার, মামলার পক্ষ, পুলিশ অফিসারসহ মামলার সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, শিশুর পিতামাতা বা অভিভাবক এবং আদালত কর্তৃক বিশেষভাবে অনুমোদিত ব্যক্তিরা আদালতে উপস্থিত থাকবেন। মামলার শুনানির ক্ষেত্রে আদালত যদি ওই শুনানির উদ্দেশ্যে শিশুটির হাজির থাকা আবশ্যক মনে না করেন, তবে আদালত তার হাজিরা মওকুফ করতে এবং তার অনুপস্থিতিতেই মামলার শুনানি চালিয়ে যেতে পারবেন।
গ্রেফতারের ক্ষেত্রে
শিশুটিকে গ্রেফতার করা হলে যে থানায় তাকে আনা হয় সেই থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার অবিলম্বে শিশুর পিতামাতা বা অভিভাবককে যদি তাদের খুঁজে পাওয়া যায়, এরুপ গ্রেফতার সম্পর্কে অবহিত করবেন এবং যে আদালতে শিশুটিকে হজির করা হবে সে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য তারিখ নির্দিষ্ট করে তার প্রতি নির্দেশ দানের ব্যবস্থা করবেন। আবার আদালতে আনিত কোন শিশু যদি এরূপ রোগাক্রান্ত থাকে যে, তাকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করা প্রয়োজন অথবা এরূপ শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণাগ্রস্ত হয়, যার দীর্ঘদিন চিকিৎসা সম্ভব হতে পারে তাহলে আদালতে শিশুটিকে কোন হাসপাতাল অথবা স্বীকৃত অন্য কোন স্থানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার জন্য যতদিন আবশ্যক মনে করেন ততদিনের জন্য প্রেরণ করবেন।
শিশু আইনে শিশু সম্পর্কিত মামলার সংবাদ প্রকাশেও সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। কোন সংবাদপত্রের রিপোর্টে কোন মামলার শিশু জড়িত এমন বিস্তারিত বর্ণনা প্রকাশ করা যাবেনা, যাতে তাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে শনাক্ত করা যায়এমনকি কোন শিশুর ছবিও প্রকাশ করা যাবেনা। তবে শিশু কল্যাণের স্বার্থের অনুকূলে হবে বা শিশুর স্বার্থের কোন ক্ষতি হবেনা এমন সংবাদ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে করা যাবে।
শিশুর প্রতি অপরাধ
বাংলাদেশ শিশু আইনে এমন কিছু অপরাধ রয়েছে, যা শিশুদের প্রতি করা হলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। যেমন-
ক) কোন ব্যক্তি যদি তার অধীনস্থ শিশুকে আঘাত, দুর্বব্যহার, অবহেলা, পরিত্যাগ বা অন্য কোন অমানবিক নির্যাতন করে তবে সেই ব্যক্তিকে ২ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ১০০০ টাকা জরিমানা করা যাবে।
খ) কোন শিশুকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত করলে সে ক্ষেত্রে দোষী ব্যক্তিকে ১ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৩০০ টাকা অর্থদন্ড দেয়া যাবে।
গ) মাতলামির কারণে শিশুর যত্ন গ্রহণে অপারগ হলে সেই দোষী ব্যক্তিকে ১০০ টাকা অর্থদন্ড প্রদান করা যাবে।
ঘ) কোন শিশুকে মদ বা জীবনহানিকর ওষুধ প্রদান করলে সেই অপরাধী ব্যক্তির ১ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৫০০ টাকা জরিমানা করা যাবে।
ঙ) কোন শিশুকে পতিতালয়ে গমন বা বসবাসে উদ্বুদ্ধ করলে অপরাধীর ২ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ১০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে।
চ) ১৬ বছরের কম বয়সী বালিকাকে অসৎ জীবনযাপনে উৎসাহিত করলে অপরাধীর ২ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ১০০০ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড হতে পারে।
ছ) কোন শিশুকে শ্রমে নিয়োগ করলে এবং তার উপার্জিত অর্থ গ্রহণ করলে সে ক্ষেত্রে অপরাধীর ১০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে।
শিশুর শাস্তি
শিশু অপরাধীদের ক্ষেত্রে বিচার বা শাস্তি নমনীয় ও সংশোধমূলক হয়ে থাকে। শিশুদের বিবেক, বুদ্ধি বা নৈতিকতাবোধ স্বভাবতই অপরিপক্ব থাকে। তাই শিশুদের দ্বারা সংঘটিত যে কোন অপরাধ অনিচ্ছাকৃত বা ভুলবশত ঘটে বলে ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে ৭ বছরের কম বয়স যার, সে একেবারেই নিষ্পাপ শিশু।
আইন অনুযায়ী সে কোন অপরাধ করতে পারেনা। বাংলাদেশ দন্ডবিধি মতে, ৭ বছর থেকে ১২ বছরের মধ্যে যার বয়স সে যদি কোন অপরাধ করে তবে তাকে তখনই অপরাধী বলে গণ্য করা যায় যখন দেখা যায় তার বুদ্ধি পরিণত হয়েছে।
অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধী শিশুকে নির্ধারিত সময়ের জন্য সরকার নিয়ন্ত্রিত সংশোধনী প্রতিষ্ঠানে প্রেরণের আদেশ দেয়া হয়। বিভিন্ন মেয়াদে শিশুদের এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাখা হয়।
গুরুতর অপরাধের জন্য সর্বনিম্ন ২ বছর এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সংশোধনীমূলক প্রতিষ্ঠানে শিশুঅপরাধীদের রাখা হয়। যে কোন গুরুতর অপরাধের জন্য শিশু অপরাধীদের মৃত্যুদন্ড, দ্বীপান্তর বা হাজতবাসের আদেশ দেয়া যাবেনা। শিশু অপরাধীদের বিচারকার্য বা বন্দি অবস্থা কোনভাবে বয়স্ক কয়েদিদের সঙ্গে হবেনা।
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট