টাঙ্গাইলের জাহালমকে ‘ভুল’ আসামি করার বিষয়টি তদন্তে উঠে এলেও তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি বা জামিন না দেওয়ার ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ভর্ৎসনা করে হাইকোর্ট বলেছেন, ‘যে বিড়াল ইঁদুর ধরতে পারে না, সে বিড়াল থাকার দরকার নেই।’
এ মামলার শুনানি চলাকালে আজ বুধবার (৬ মার্চ) বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
আদালতে দুদকের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। আর ভুক্তভোগী জাহালমের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত।
মামলার শুনানিতে দুদক আইনজীবীকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, ‘কেউ চায় না, দুদক সম্পর্কে মানুষের ধারণা খারাপের দিকে যাক। তবে দুদককেও পরিচ্ছন্ন (ক্লিন) হতে হবে।’
এসময় দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘চ্যানেল ২৪–এ জাহালমের বিষয়ে রিপোর্ট আসার পর জাহালম যে নির্দোষ সে বিষয়ে দুদক তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়। সে তদন্তে জাহালম যে নির্দোষ তা উঠে আসে। তদন্তে দেখা গেছে যে, সে অভিযুক্ত না। তাই আমরা তো বিষয়টি নিয়ে সঠিক পথেই আছি।’
তখন আদালত বলেন, ‘চ্যানেল ২৪–এ রিপোর্ট হওয়ার আগে তিনি (তদন্ত কর্মকর্তা) কী করেছেন? দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। আপনাদের অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। যে বিড়াল ইঁদুর ধরতে পারে না, সেই বিড়াল থাকার দরকার নেই।’ জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, ‘আমাদেরও সীমাবদ্ধতা আছে।’
আদালত বলেন, ‘আগে অনেকেই দুর্নীতিকে ঘৃণা করতো। কিন্তু এখন এই অবস্থার অবক্ষয় হচ্ছে।’
এরপর দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে জাহালমকে নিয়ে আমরা তদন্ত করেছি।’ আদালত তখন বলেন, ‘আপনারা সেসব তথ্য কী যাচাইবাছাই করবেন না? আপনারা রিপোর্টে বলছেন, জাহালম ১৮ ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছে। কিন্তু এখন মুখে ২টি ব্যাংককে মামলায় পক্ষভুক্ত করতে চাচ্ছেন?’
দুদক আইনজীবী বলেন, ‘আমাদের কাছে মামলার সব ফাইল আছে। একটু সময় দিন, সব আপনাদের দেবো।’
তখন আদালত দুদক আইনজীবীর কাছে জানতে চান, ‘ব্রাক ব্যাংকের একজনকে সাক্ষী বানালেন, কিন্তু আসামি করলেন না কেন? আপনারা জাহালমের মামলাটি তদন্ত করেছেন কিনা?’ দুদক আইনজীবী বলেন, ‘করেছি। তদন্ত শেষ পর্যায়ে আছে।’
আদালত জানতে চান, ‘জাহালমকে যে নির্দোষ তা কবে জানতে পারলেন?’ জবাবে দুদক আইনজীবী বলেন, ‘চ্যানেল ২৪ থেকে জানার পর গত ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে তদন্ত করার পর তার নির্দোষের বিষয়ে জানতে পারি।’
আদালত বলেন, ‘তদন্ত করে যখন দেখলেন সে নির্দোষ, তখন তাকে প্রসিকিউশন ছেড়ে দিলো না কেন? তদন্তের পর আপনাদের উচিত ছিল তার জামিন দেওয়া। এরপরও মামলার শুনানিকালে আদালতে ও আপনাদের কাছে সে বারবার বলেছে– আমি জাহালম, আবু সালেক না। তারপরও তার জামিনের ব্যবস্থা করলেন না। তাহলে তার বিরুদ্ধে কিসের ভিত্তিতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করলেন? এর দায় আপনাদের নিতে হবে।’
এসময় দুদক আইনজীবী বলেন, ‘আমাদের সময় দিন। আমরা সব কাগজ-প্রমাণ আদালতে দাখিল করবো। আপনারা এখন এ মামলায় দুইটি ব্যাংককে পক্ষভুক্ত করে নিন।’ তখন আদালত বলেন, ‘আপনারা পিক অ্যান্ড চুজ করছেন।’
জবাবে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘কোর্ট চাইলে আমরা সবাইকে (১৮টি ব্যাংক) পক্ষভুক্ত করে নেবো।’ আদালত বলেন, ‘যাকে আসামি বানানোর কথা ছিল, তাদের আপনারা সাক্ষী বানিয়েছেন। অন্য সব ব্যাংকগুলোকে পক্ষভুক্ত করতে হবে। যেখানে অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়ছে, সেখানে সিন্ডিকেট করে সব নিয়ে যাচ্ছে; এটা দেখা দরকার।’
এরপর আদালত এ মামলার সব নথি তলব করে মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১০ এপ্রিল দিন ধার্য করেন।
প্রসঙ্গত, গত ২৮ জানুয়ারি ২৬ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে থাকার অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি ও মামলার বাদীসহ চার জনকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। দুদকের চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী, স্বরাষ্ট্র সচিবের একজন প্রতিনিধি ও আইন সচিবের একজন প্রতিনিধিকে উপস্থিত থেকে এ ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। এ বিষয়ে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন উপস্থানের পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিচারপতি নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
একটি জাতীয় দৈনিকে ৩৩ মামলায় ‘ভুল’ আসামি জেলে, ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত।
ওই প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপনের পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন হাইকোর্ট।
দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির দায়ে ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটছেন, আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক।
জাহালমের কারাবাসের তিন বছর পূর্ণ হবে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি। দুদক বলছে, জাহালম নিরপরাধ প্রমাণিত হয়েছেন। তদন্ত করে একই মত দিয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও। ফলে একটি মামলায় তার জামিন হয়েছে। আরও ৩২টি মামলায় জামিন পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন তিনি।’