কাজি ফয়জুর রহমান :
অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে। এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এজন্য দেশে দেশে আইন-আদালতের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থা চালু রয়েছে। অপরাধের সাজা হিসেবে কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড কিংবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধানযুক্ত করে আইন তৈরি করা হয়েছে। বিচারক তার বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় নিয়ে আইন অনুযায়ী সাজা দিয়ে থাকেন। ফলে অন্যায় করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বিচারকের দেওয়া সাজার চেয়েও বেশী দণ্ড যদি ভোগ করতে হয় তাহলে সেটা কি ন্যায় বিচার বলা যাবে?
একটা বাস্তব উদাহরণ দিয়েই বলি, ২০১০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও থানার পশ্চিম নাখাল পাড়া এলাকা থেকে ১০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ গ্রেপ্তার হন দীপন চন্দ্র দাস ওরফে শাকিল। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় শাকিলের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা (নং ৭৭) করেন। ২০১১ সালের ৩১ জানুয়ারি পুলিশ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। এরপর আসামির বিরুদ্ধে একই বছরের ১৫ মার্চ অভিযোগ গঠন করেন আদালত। পরে ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল আসামি শাকিল জামিন গিয়ে পলাতক থাকেন। মামলাটির দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে বিচার চলাকালে তিনজন সাক্ষীর জবানবন্দি নেন আদালত। মামলায় ২০১৫ সালের ১০ মার্চ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ১৯(১) ও ৯(ক) ধারায় ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত আসামি শাকিলের অনুপস্থিতিতে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। এরপর শাকিলের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানা ইস্যু করেন বিচারক। গত বছরের ৬ এপ্রিল সাজা পরোয়ানা মূলে গ্রেফতার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ শাকিলকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে। বিচারক তাকে কাস্টডি ওয়ারেন্ট দিয়ে জেলহাজতে পাঠান। নিয়মানুযায়ী ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসেই শাকিলের মুক্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু ছয় মাসের সাজা মাথায় নিয়ে কারাগারে গেলেও ১১ মাস পরও তার মুক্তি মেলেনি। যদিও গত সোমবার (৪ মার্চ) তাকে মুক্তি দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন বিচারিক আদালত। (সূত্র : বাংলাট্রিবিউন)
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পাঁচ মাস বিনাবিচারে শাকিলের কারাভোগের দায় নেবে কে? অপরাধীর অতিরিক্ত দণ্ড ভোগের দায় কে নেবে সে বিষয়ে আইনে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯৮ এর ৩৫ (ক) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, কেবলমাত্র মৃত্যুদণ্ডের অপরাধ ব্যাতীত অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রে সশ্রম বা বিনাশ্রম যে কোন প্রকারের কারাদণ্ড প্রদানের রায় দেওয়া কালে বিচারাধীন সময়ে আসামির হাজতবাসের সময়কাল গণনার মধ্যে নিতে হবে। কারাবাস দণ্ডের সময়কালের অধিক হলে দণ্ড ভোগ সম্পন্ন হয়েছে বলে গণ্য হবে। এছাড়া অন্য কোন মামলায় কারাগারে আটক রাখার প্রয়োজন না হলে অবিলম্বে মুক্তি প্রদান করতে হবে।
এ বিষয়ে ২০১৭ সালে মাঝামাঝি সময়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জারিকৃত এক নির্দেশনায় কারাদণ্ডের মেয়াদের চেয়ে হাজতবাস অধিক হলে আসামিকে তাৎক্ষণিক মুক্তি প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে অর্থদণ্ড মওকুফ করে রায়ে ও সাজা পরোয়ানায় উল্লেখ করার জন্য বলা হয়।
বলা হয়ে থাকে, কোন অপরাধীকে বিনা বিচারে একদিনও কারাগারে বন্দী রাখা সংবিধান ও মানবাধিকার পরিপন্থী। কিন্তু দণ্ডের মেয়াদের চেয়ে হাজতবাস অধিক হলে আসামীকে তাৎক্ষণিক মুক্তির পাশাপাশি অর্থদণ্ড মওকুফ করা ব্যতীত আইনে কিছু উল্লেখ করা নেই। বিনা বিচারে হজতবাসের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ভবিষ্যতেও এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে যদি না রাষ্ট্র এ বিষয়ে এখনি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করে।
এমন ঘটনা এড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতনতা ও দায়িত্বশীলতার বিকল্প নেই। এরপরও যদি এমন ঘটনা ঘটে সেক্ষেত্রে পরামর্শ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিচারের আওতায়ভুক্ত করে বিধি প্রণয়ন করা এবং অবিচারের শিকার ব্যক্তিকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকম