ল’ইয়ার্স ক্লাব বাংলাদেশ ডটকমের বিশেষ প্রতিনিধি প্রিন্স মাহামুদ আজিমের মুখোমুখি হয়েছেন বাংলাদেশের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ মোতাহার হোসেন সাজু। ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের আজকের তৃতীয় তথা শেষ পর্বে আইনজীবীদের পেনশন এবং এফিডেভিট সংক্রান্ত সাম্প্রতিক দুইটি আলোচিত বিষয়ে কথা বলেছেন।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : সম্প্রতি উচ্চ আদালত আইনজীবীদের পেনশনের আওতাভুক্তির প্রশ্নে একটি রুল জারি করেছেন। এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
মোঃ মোতাহার হোসেন : সারা দেশের আইনজীবীদের পেনশন সুবিধা কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন উচ্চ আদালত। বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সম্প্রতি এই রুল জারি করেন। এই রুলের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের কাছ থেকে ফান্ড কালেকশান করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আইনজীবীদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ব্যক্তিগত ভাবে জনস্বার্থে করা এই মামলাটিকে আমি সমর্থন করি। কেননা, অনেক আইনজীবী রয়েছেন যারা সৎ জীবনযাপন করেন। সাধারণ মানুষের জন্য প্রাণপণে কাজ করেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, আইনজীবীরা নিজে কষ্টে জীবনযাপন করলেও বিনা পয়সায় সাধারণ বিচারপ্রার্থীদের জন্য আদালতে মামলা পরিচালনা করে থাকেন। তাই আইনজীবীদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা করা হলে একদিকে যেমন সিনিয়র আইনজীবীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তামুক্ত থাকবেন অপরদিকে তরুণ আইনজীবীরাও পেশাগত সততা বজায় রাখতে অনুপ্রাণিত হবেন। আপনি হয়তো জেনে থাকবেন, আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অঙ্গরাজ্য বিহারে ২০১৪ সালে সে দেশের বার কাউন্সিল এই ধরণের একটি আইন চালু করেছেন। যেখানে একজন আইনজীবী একাধারে ৩০ বছর প্র্যাকটিস করলে কিংবা কোন আইনজীবীর বয়স ৬৫ অতিক্রান্ত হলে তিনি অবসর না নিলেও প্রতিমাসে ৫০০০ রুপি পেনশন পাবেন। এছাড়াও কোন আইনজীবী ১০ বছর প্র্যাকটিস করে কোন কারণে মৃত্যুবরণ করলে উক্ত আইনজীবীর পরিবার কিংবা নমিনি প্রতি মাসে ২৫০০ রুপী করে ভাতা পেয়ে থাকেন। এই ধরণের ব্যবস্থা চালু করে ভারত আইনজীবীদের কল্যাণে নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। যা বাংলাদেশে চালু করা গেলে প্রত্যেক আইনজীবী তথা আইনজীবীদের পরিবারবর্গ অন্তত দুই মুঠো খেয়ে পরে বাঁচার নিশ্চয়তা পেতেন।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : একজন আইনজীবী হিসাবে এই মামলাটি নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কি, তা জানতে চাই।
মোঃ মোতাহার হোসেন : আদালতের বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত নয় তবু প্রত্যাশার কথা যদি বলেন তাহলে একজন আইনজীবী হিসেবে এতটুকু বলতে পারি, আইনজীবীদের পেনশনের আওতাভুক্ত করা হবে না কেন, এইটা নিয়ে সবে মাত্র হাইকোর্টে রুল জারি হয়েছে। উক্ত রুলে সরকারের কয়েকটি মন্ত্রণালয়কে পক্ষ করা হয়েছে। যখন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জবাব দাখিল করবে এবং উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে সেটা শুনানি হওয়ার পর আদালত রায় দিলে বলা যাবে আসলে এই মামলার ভবিষ্যৎটা কি হবে? সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : এফিডেভিট করার জন্য আইনজীবীদেরকে এফিডেভিট কমিশনারের সামনে উপস্থিত থাকতে হবে, উচ্চ আদালতের এই নির্দেশনা সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কি?
মোঃ মোতাহার হোসেন : পত্রপত্রিকার বরাতে আমি শুনেছি, দুই একটি কোর্ট এমন মৌখিক আদেশ দিয়েছেন। আমার প্রায় তিন দশকের প্র্যাকটিস জীবনে কখনো কোন আইনজীবীকে এফিডেভিট কমিশনারের কাছে এফিডেভিট করার জন্য যেতে হয়েছে এমনটা আমি দেখিনি কিংবা যারা আমার থেকেও সিনিয়র প্র্যাকটিসনার তারাও এই ধরণের নজির দেখেননি। এটা খুবই কষ্টকর। আইন পেশায় এমন অনেক আইনজীবী রয়েছেন যাদের প্র্যাকটিসের বয়স ৫০-৬০ বছরের মতো হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রে যাদের প্রচুর মামলা তাদের জুনিয়ররা ওকালতনামায় স্বাক্ষর দিচ্ছেন আবার যাদের মামলা কম, সেক্ষেত্রে সিনিয়ররাও ওকালতনামায় স্বাক্ষর করছেন। এরকম অনেক প্র্যাকটিসনার আছে যাদের মামলা কম কিন্তু প্র্যাকটিসের বয়স প্রায় ৫০ বছর ছাড়িয়ে গেছে। সে ব্যক্তির পক্ষে কোনোক্রমে এফিডেভিট কমিশনারের সামনে উপস্থিত থাকা সম্ভব?এছাড়াও একজন আইনজীবী, যাকে বলা হয় অফিসার্স অফ দ্যা কোর্ট। তাঁর থেকে অধনস্ত কারো কাছে গিয়ে মামলার হলফনামা সম্পাদনের জন্য উপস্থিত থাকার চেয়ে কলঙ্কযুক্ত আর কোন কিছু হতে পারে না।
ল’ইয়ার্স ক্লাব : উচ্চ আদালত এই ধরণের আদেশ কেন দিয়েছেন এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি?
মোঃ মোতাহার হোসেন : অনেক অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে ভুয়া আদেশ তৈরি করে জামিন জালিয়াতি হচ্ছে। বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের আট – নয় হাজার আইনজীবীদের মধ্যে মূলত প্র্যাকটিস করেন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার আইনজীবী। সে ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতিদিন কমপক্ষে তাদের এক-দেড় হাজার মামলা থাকে। এই মামলাগুলোর জন্য এফিডেভিট করতে যাওয়া কোনক্রমেই সম্ভব না। বিশেষ করে যাদের চেম্বারে বেশী মামলা তাদের পক্ষে এটা আরও বেশী কষ্টসাধ্য।
কিছু কিছু অসাধু আইনজীবী অতিরিক্ত টাকা কামানোর উদ্দেশ্যে এমন জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে থাকেন। এফিডেভিট কমিশনারের সামনে আইনজীবী উপস্থিত থাকার নিয়ম করে দেওয়া এসব জালিয়াতি থেকে পরিত্রাণের উপায় হতে পারে না। কারণ উচ্চ আদালতের কোন আইন বা বিধি এফিডেভিট করার জন্য আইনজীবীদের এফিডেভিট কমিশনারের কাছে যাওয়াটা সমর্থন করে না। এছাড়াও হাইকোর্ট বা আপিল বিভাগে এমন কোন নির্দেশনা নেই যে, এফিডেভিট করার জন্য আইনজীবীকেই এফিডেভিট কমিশনারের সামনে উপস্থিত থাকতে হবে। আইনজীবীকে এফিডেভিট কমিশনারের সামনে উপস্থিত না থেকেও এই সমস্যা সমাধানের অনেক উপায় আছে। বিশেষ করে জজ সাহেবরা (বিচারপতিরা) যদি সুনির্দিষ্ট করে আদেশ দেন (যে আসামির সাথে কতগুলো ইয়াবা/অস্ত্র জব্দ হয়েছে) তাহলে এই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কেউ আর জালিয়াতির সুযোগ পাবে না।