রাম চন্দ্র দাশ :
উপক্রমনিকা
- প্রথাবিরোধী শিখন ও অদম্য আইনপেশা : বাংলাদেশে আইন শিক্ষার উপর একটি প্রতিফলন (ANTI-GENERIC LEARNING AND REBELLIOUS LEARNING: REFLECTION ON LEGAL EDUCATION IN BANGLADESH) ২০৮ পৃষ্ঠার এই বইটি ইংরেজিতে বিজয় প্রকাশ কর্তৃক ২০১৮ সালে প্রকাশিত। বইটির লেখক খ্যাতিমান ও সুপরিচিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক জনাব ড. মিজানুর রহমান। লেখকের আরেকটি পরিচয় হল তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান। প্রাক্-কথনে উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর তিন দশকের শিক্ষকতা-জীবনের নিংড়ানো অভিজ্ঞতার আলোকে ১১টি প্রবন্ধের সংকলন করেছেন এই বইয়ে।
- এই বইটির ভূমিকা (FORWARD) লিখেছেন আইন জগতের অন্যতম জীবন্ত কিংবদন্তী, পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মাধব মেনন, পরিচালক (অনারারি), কেরেলা বার কাউন্সিল এম কে এন একাডেমি এবং প্রাক্তন উপাচার্য, জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়, বেঙ্গালোর ও কলকাতা, ভারত। ভূমিকার প্রথম বাক্যটি এরকম. “যারাই ড. মিজানুর রহমানের জীবন ও কাজ সম্পর্কে অবগত আছেন, তারা স্বীকার করবেন যে, তিনি একজন অসাধারণ শিক্ষক, জুরিস্ট, এক্টিভিস্ট ও মানবতাবাদী যে গরীব ও প্রান্তিক জনগণের ন্যায়বিচারের প্রয়োজনে সেবা করতে আইনের প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রস্তুত করতে ভালবাসেন।”
- প্রাক্ কথনে (PREFACE) বইয়ের মর্মবস্তু সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লেখক উল্লেখ করেন, “আমি তখনই এই পেশার স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করা শুরু করলাম, যখন আমি অনুধাবন করলাম যে, চলমান উপনিবেশবাদী আইনপেশার মডেল নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের অর্জিত উচ্চ-আদর্শ যা নাগরিকের ‘সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সমাজিক ন্যায়বিচার’ নিশ্চিত করার অঙ্গীকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না। আমি পুরাতন ও বাতিলকৃত মডেলের পরিবর্তে মৌলিকভাবে পরিবর্তিত আইনপেশার অন্যরকম মডেল-‘অদম্য বা দুর্দমনীয় আইনপেশা’- যা ‘দরিদ্রদের জন্য আইনপেশা’কে (lawyering with the poor) উদ্দেশ্য হিসাবে বিবেচনা করে। আমি বিশ্বাস করি যে, ‘অদম্য আইনপেশাজীবীরা’ এই দেশে একটি নতুন দরিদ্রবান্ধব এবং জনবান্ধব আইনবিজ্ঞানের পথ প্রদর্শন করবেন।”এই বইয়ে তিনি নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব বিজ্ঞ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের আমন্ত্রণে একটি অনুশীলনধর্মী প্রশিক্ষণ উদ্ভাবন, সমন্বয় ও বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতাও সংজোযন করেন (প্রাথমিকভাবে প্রশিক্ষণটির নাম Continuing Legal Education Program- CLEP, যা পরবর্তীতে নাম বদলিয়ে রাখা হয় Bar Vocational Course- BVC)। এই বইয়ে প্রধানত দুটি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে, (১) বাংলাদেশে আইনশিক্ষার বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ করণীয় এবং (২) প্রথাগত আইনপেশার পরিবর্তে ‘অদম্য আইনপেশা’র স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন।
বাংলাদেশে আইনশিক্ষার বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ করণীয় - বাংলাদেশে আইনশিক্ষার বর্তমান অবস্থা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক নিচের বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন-
(১) খুব কম সংখ্যক সাধারণ পদ্ধতি- কেউ কেউ বলেন একটি মাত্র পন্থা আমাদের আইনশিক্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করে অর্থাৎ একই রকম পাঠ্যক্রম ও সিলেবাস দিয়ে সবাইকে (অনার্স, পাসকোর্স) সারা দেশেই পড়ানো হয়- যা আইনের শিক্ষকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ফ্লেক্সিবল পন্থা অবলম্বনে নিরুৎসাহিত করে।
(২) খুব কম সংখ্যক শিখন-শিক্ষণ মডেল, কেউ কেউ বলেন একটি মাত্র পদ্ধতি বাংলাদেশের আইনশিক্ষার কাঠামো ও রুটিনকে আকৃতিদান করে। অর্থাৎ বড় শ্রেণিকক্ষে অনেক শিক্ষার্থী নিয়ে বক্তৃতার মাধ্যমে শিক্ষককে শেখাতে হয়।
(৩) খুব কম সংখ্যক ‘দক্ষতা’ শেখানো হয়, অন্যদিকে সাধারণ পন্থাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাংলাদেশে আইনশিক্ষায় অদ্যাবধি বিভিন্ন ধরনের আইনজীবীর জন্য যেসব দক্ষতার প্রয়োজন হয় তার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা খুবই সীমাবব্ধ।
(৪) খুব কম ক্ষেত্রেই সঠিক আইনের তাত্ত্বিক ধারণা প্রদান করা হয়। পক্ষান্তরে, আমাদের কোর্সসমূহ ভিতরগত তাত্ত্বিক ধারণাকে চিহ্নিতকরণ ও বিশ্লেষণে, মানব মিথষ্ক্রিয়ার ধারণা, দ্বন্দের ধারণা, পুঁজিবাজার, সমস্যা-সমাধান ও রাষ্ট্রের ধারণা প্রদানে খুবই কম সময় ও শ্রম প্রদান করা হয়ে থাকে।
(৫) খুব কম ক্ষেত্রেই প্রাত্যহিক জীবনে আইনের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হয়। মানুষ কী চিন্তা ও অনুভব করে এবং প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে কাজ করে ও পরিবর্তন হয়- তা সম্পর্কে খুবই অপ্রতুল ধারণা প্রদান করা হয় অর্থাৎ আমাদের আইনশিক্ষার উপকরণ বিমূর্ত বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা ও আলোচনা করে, যা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটনাসমূহ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে, যদিও সেগুলোই একজন আইনজীবীকে মোকাবেলা করতে হয়।
(৬) জনগণের স্বপ্ন, প্রথাসমূহ ও অভিজ্ঞতাকে খুবই সাদামাটাভাবে আইনশিক্ষায় শেখানো হয়, যেন মনে হয় সব জনগণ ও সবার সামাজিক জীবন একই রকম।
(৭) বার কাউন্সিল কর্তৃক খুবই সংকীর্ণ ও খুবই প্রথাগত আইনশিক্ষা/প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রাথমিকভাবে প্রথাগত আইনশিক্ষার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য কিছু ‘অব্যাহত আইনশিক্ষার কার্যক্রম’ পরিচালনার উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবে কখনওই এই কার্যক্রম ‘মামলা পরিচালনা’র সীমাকে অতিক্রম করতে পারেনি। (পৃ: ২২-৩০)
- উপরোক্ত প্রথাগত আইনশিক্ষার বিপরীতে লেখক ‘প্রথাবিরোধী-শিখন (anti-generic learning)’ সম্পর্কে নিচের বিষয়গুলোর অবতারণা করেছেন-
- (১) পাঠ্যক্রমে সামাজিক মূল্যবোধকে অন্তর্ভূক্তিকরণ যার মাধ্যমে আইনের শিক্ষার্থীরা দারিদ্র্যের কারণে অসুবিধাগ্রস্তদের জন্য কাজ করার বিষয়টিকে তাদের সুদীর্ঘ পেশাজীবনে দায়িত্ব হিসাবে বিবেচনা করতে পারেন।
- (২) আইন শিক্ষায় বহুবিধ বিষয় যেমন অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, নৃ-বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ও মনোবিজ্ঞান এবং মানাবাধিকারকে অত্যাবশ্যকীয় পাঠের আওতায় এনে আইন পাঠের বিষয়বস্তুকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা প্রয়োজন।
- (৩) প্রায়োগিক দক্ষতার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাত্ত্বিক শিক্ষা ও প্রয়োগের মধ্যে দূরত্ব কমানো।
- (৪) আইনগত নৈতিকতার প্রশিক্ষণ অন্তর্ভূক্তকরণের পাশাপাশি পাঠ্যক্রমের প্রতিটি পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষাকে আনা প্রয়োজন।
- (৫) আইনশিক্ষায় শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের আইন শিক্ষককে বুঝতে হবে যে, “শেখা হল শিক্ষার্থীরা যা করে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য করা হয় তা নয় (Learning is something students do, not something that is done to students; Hess & Friedland, 1999: 131)”। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের দলীয়-শেখার কাজ অনুশীলনের মাধ্যমে, ‘প্রতিযোগিতার সংস্কৃতির’ পরিবর্তে ‘সহযোগিতার সংস্কৃতি’ চালু করা প্রয়োজন কারণ ‘সহযোগিতামূলক দক্ষতা’ সমাজে ও আইনপেশায় গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত।
- (৬) শিখন পদ্ধতি ও উপকরণে বহুমুখিতা যেমন ‘দলীয়-শেখার পাশাপাশি অডিও-ভিজ্যুয়েল যন্ত্রের ব্যাবহার এবং আরো অংশগ্রহণমূলক টেকনিক অবলম্বন প্রয়োজন।
- (৭) আইনশিক্ষায় বিশ্বায়নের ধারণার অন্তর্ভূক্তিকরণ, যার ফলে আইনজীবীরা শুধুমাত্র ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে একমাত্রায় চিন্তা ও বিশ্লেষণ না করে, বরং একই সাথে তুলনামূলক আইন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক আন্তর্জাতিক আইনের বিভিন্ন মাত্রায় তা করতে পারে।
- (৮) আইনশিক্ষায় বিকল্প বিরোধ-নিষ্পত্তির বিষয়টি যেমন, নেগোসিয়েসন, মধ্যস্থতা ও শালিসের মাধ্যমে বিরোধ-নিষ্পত্তি, সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজের সম্পর্ক ইত্যাদিকে আরো বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
- (৯) সামাজিক আইন ও এডভোকেসি (community law and advocacy) নামে নতুন বিভাগ খোলা প্রয়োজন। এই নতুন ধরনের আইনজীবীরা যেসব প্রান্তিক মানুষ বর্তমান বিচার ব্যাবস্থার নাগাল পায় না তাদের জন্য কাজ করবে। (পৃ: ৫১-৫৫)
উপরোক্ত প্রথাবিরোধী-শিখন বাস্তবায়নের জন্য বেশ কিছু পরীক্ষণও পরিচালিত হয়, যেমন- ‘ক্লিনিক্যাল আইন শিক্ষা’ যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষণ হয়, এছাড়া Empowerment through Law of the common people (ELCOP), Human Rights Summer School (HRSS), Community Law Reform ইত্যাদি পরীক্ষণের মাধ্যমে ‘অদম্য আইনপেশা’ (rebellious lawyering) এর ধারণা দানা বাঁধতে শুরু করে- যারা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে, ‘গরিবের জন্য আইনপেশা মানেই ন্যায়বিচারের জন্য আইনপেশা’। (পৃ: ৭৬-৮৬)
প্রথাগত আইনপেশার পরিবর্তে ‘অদম্য আইনপেশা’র স্বপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন
- ‘অদ্যম আইনপেশা (rebellious lawyering)’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক প্রথমেই বলেন, “সুচিন্তিতভাবে প্রথাগত আইনপেশাকে ত্যাগ করতে শুধুমাত্র ‘মক্কেলকে প্রতিনিধিত্ব করার’ সংস্কৃতি ভেঙে ‘সমস্যা সমাধানের জন্য মক্কেলকে কেন্দ্রবিন্দুতে আনা (client-centered) হল অদম্য আইনপেশার প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য। তিনি আরো বলেন, ‘অদম্য আইনজীবীরা অবশ্যই নিজেদের কাজকে সমাজের সাধারণ মানুষের জীবনে ও তাদের কমিউনিটিতে অঙ্গীভূত করবেন। নিদেনপক্ষে, অদম্য আইনপেশার ধারণাটি প্রত্যাশা করে যে, আইনজীবী ও তাদের সহযোগীরা সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সংবেদনশীলতা ও সমষ্টিগত সংগ্রামের উপযোগী দক্ষতাকে লালন-পালন করেন। এছাড়া, এই ধরনের আইনপেশা সাধারণ মক্কেলদের ক্ষমতায়িত করতে চায় এবং মক্কেলদের বস্তুগত লাভের জন্য আইনী-ব্যবস্থা কতটা উপযুক্ত এই প্রশ্ন করে। প্রথাগত আইনপেশাকে বাদ দিতে নতুন প্রজন্মের অদম্য আইনজীবীদের এমন এক ধরনের আইনপেশার কথা ভাবতে হবে যা মক্কেলদের স্বার্থ, চিন্তাধারা ও মক্কেলের সক্রিয় ভূমিকা থেকে উৎসারিত- যা ‘মক্কেল-কেন্দ্রিক আইনপেশা’ নামে পরিচিত” (পৃ: ৯০-৯১)।তাই তিনি বলেছেন, “অদম্য আইনজীবীদের প্রাথমিক কাজ হল- বর্তমান স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে কাজ করা যা আরো ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও সমতাপূর্ণ ব্যবস্থার অনুকূলে। এই জন্যই অদম্য আইনপেশার গৃহীত মনোবৃত্তি হল- ‘গরীবের জন্য আইনপেশা মানে ন্যায়বিচারের জন্য আইনপেশা’” (পৃ: ৯৬)।
- ক্লিনিক্যাল লিগ্যাল এডুকেশন কর্মসূচির আওতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষামূলক যে ‘লক্লিনিক’ পরিচালিত হয় সেখানে অদম্য আইনপেশার বৈশিষ্ট্যকে নিম্নোক্তভাবে ধারণ করা হয়েছে-
(১) সমস্যা সমাধানে আইনগত ও অ-আইনগতপন্থা (legal and non-legal approach) অবলম্বন;
(২) সামাজিক ও রাজনৈতিক অধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করতে অন্যান্যদের সাথে কাজ করার উপায় জানা;
(৩) মামলা পরিচালনা ও তৎসংক্রান্ত স্বার্থের বাইরে গিয়ে বৃহত্তর প্রয়োজনে কিভাবে সংঘের অংশ হতে হয় ও কিভাবে তাদেরকে তৈরি করতে হয় তা জানা;
(৪) সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সংবেদনশীলতা ও সমষ্টিগত সংগ্রামের উপযোগী দক্ষতাকে লালন-পালন করা;
(৫) আইনপেশার কাজকে অন্তর থেকে একেবারে তৃণমূলের জন্য করা। - উপরোক্ত কর্মসূচির আওতায় বলা হয় যে, অদ্যম্য আইনপেশা হল মূলত ক্ষমতায়নের জন্য। ক্ষমতায়নের জন্য আইনপেশার ভাবনাগুলো নিম্নরূপ-
(১) মামলা পরিচালনা হল সমস্যা সমাধানের অনেক পন্থার মধ্যে একটি মাত্র;
(২) দরিদ্র/কমিউনিটির সাথে সংযুক্ত হতে আইনজীবী সর্বদাই কাজ করেন;
(৩) আইনজীবীর নিজের স্বস্তিবোধের সাথে অন্যায্য আইনীব্যাবস্থার দ্বন্দ তৈরি করতে ইচ্ছা পোষণ করেন;
(৪) কমিউনিটির আইনশিক্ষার উদ্দেশ্যে-
(ক) ব্যক্তি ও দলের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা,
(খ) ম্যানুয়েল ও অন্যান্য উপকরণ রচনা,
(গ) নতুন আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ প্রদান,
(ঘ) স্থিতাবস্থার (status-quo) বিরুদ্ধে বিভিন্ন দলকে শিক্ষা প্রদান। (পৃ: ১৭১) - এই বিশ্বায়নের যুগে আইনপেশা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে লেখক উল্লেখ করেন যে, “কোর্ট-কেন্দ্রিক আইনপেশার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হল- দ্রুত পরিবর্তনশীল বিভিন্ন পেশা ও ব্যবসায়ী মক্কেলদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য সেবার অত্যাবশ্যকীয় উপাদানকে সংরক্ষণ করে সেবার উন্নয়ন করা যা আবার প্রকৃতপক্ষে কোর্ট-প্রক্রিয়ার সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল।” এ প্রসঙ্গে তিনি আরো যোগ করেন, “প্রকৃতপক্ষে, আইন অনুশীলন হল একটি বিজ্ঞ পেশা। এটির জন্য বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন হয় এবং আইনজীবীকে অবশ্যই এই পেশার ‘অংশগ্রহণের দৃষ্টিভঙ্গি (shared value of the profession)’ অর্জন করতে হয়। একজন আইনজীবীকে অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে। তিনি উদ্দীপনা নিয়ে মক্কেলকে প্রতিনিধত্ব করবেন। এক্ষেত্রে চূড়ান্ত গোপনীয়তা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং স্বার্থের দ্বন্দ (conflict of interest) অবশ্যই পরিহার করতে হবে। আইনপেশার অনুশীলন অবশ্যই নীতি-নৈতিকতার দ্বারা পরিচালিত হইবে” (পৃ: ১৭৭-১৭৮)।
- বিশ্বায়নের এই যুগে একজন আইনজীবীকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ (full human being) হতে, বৃহত্তর পরিসরে যুক্ত হতে এবং বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করে-
(১) বুদ্ধিগত জ্ঞান : এর মর্মার্থ ‘আইনজীবীর মত ভাবা (thinking like a lawyer)’ বাক্যাংশের মধ্যে নিহিত আছে, এবং এর মধ্যে একজন আইনজীবীর যেসব দক্ষতা আছে তা হল- মামলাকে শ্রেণিকরণ করা, ইস্যু চিহ্নিত করা, বিস্তারিত বক্তব্য থেকে প্রয়োজনীয় অংশ আলাদা করা, অপ্রাসঙ্গিক তথ্যাদি থেকে প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি বাছাই করা এবং প্রয়োজনীয় আইনের সাথে সম্পৃক্ত করা; তাই তাদেরকে বিভিন্ন প্রকারের নতুন ও আরো জটিল দক্ষতা এবং আইনগত সমস্যাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করার প্রয়োজন হয়।
(২) আচরণিক/ অভিজ্ঞতাপ্রসূত/ দক্ষতামূলক প্রশিক্ষণ: বিশ্বায়ন যুগের আইনজীবীদের ‘আইনজীবীদের মত কাজ করা (doing like a lawyer)’ এর বিষয়ে শিক্ষার্থী-অবস্থায় ও অব্যাহত শিক্ষায় (continuing education) উভয় ক্ষেত্রেই প্রশিক্ষিত হতে হবে। প্রথমে আইনের শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন তৈরির যুক্তি, মতামত প্রদান, শক্তিশালী লেখার দক্ষতা, সক্রিয়ভাবে শোনা, অন্যের সাথে মিথস্ক্রিয়ার দক্ষতা অর্থাৎ সমষ্টিগতভাবে কাজ করার মৌলিক দক্ষতা অর্জন করতে হবে। উক্ত মৌলিক দক্ষতাগুলোকে পরবর্তীতে আরো প্রসারিত করতে হবে যেসব দক্ষতা তা হল- বিচারিক স্তরে যুক্তি উপস্থাপন, সমঝোতার জন্য আলোচনা, আপীলস্তরে যুক্তি উপস্থাপন, ব্যক্তি, দলীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মক্কেলকে কাউন্সেল করা, মতবিরোধ ও লেনদেনের সমঝোতা, জোটের সাথে সমঝোতা, মক্কেল ও বিপক্ষ দলের সাথে সমঝোতা, এবং আইনসভা, সরকারি এজেন্সি ও বিদেশী সরকারের সাথে সমঝোতা।
(৩) মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিগত শেখা: ভাল আইনজীবীকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ, মূল্যবোধ ও ব্যক্তিগত পছন্দ (যাকে তিনি আইনগত সহায়তা প্রদান করেন অর্থাৎ মক্কেল) বিষয়ে কল্পনার (imagination) উন্নয়ন করতে হবে। এভাবে আইনজীবীকে অবশ্যই ‘অন্যকে অনুভব করা’ শিখতে হবে। এই প্রক্রিয়াকে অনেক সময় ‘সমবেদনা প্রশিক্ষণে’র (empathy training) অন্তর্ভূক্ত করা হয়- যা মক্কেল-আইনজীবী সম্পর্ক উন্নয়নের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং এটি শেখা যায় ও শেখানোও যায়।
(৪) নিয়মাত্মক বা মান-নির্ধারক শেখা (Normative Learning): আইনজীবীকে অবশ্যই তিনি যা করেন তার ফলাফল সম্পর্কে বিবেচনা করতে হবে- তার আইনীসেবা ও সিদ্ধান্ত তার মক্কেল, মক্কেলের পারিপার্শ্বিকতা ও বৃহত্তর সমাজে কতটুকু কাজ করে এবং প্রভাব পরে; সংক্ষেপে বলতে গেলে, আইনজীবীকে তার কাজের ফলাফল বিবেচনা করতে শিখতে হবে- অর্থাৎ কাজটি ক্ষতির চেয়ে বেশি উপকার করছে কি না? একই সাথে আইনজীবী তার নিজেকে, মক্কেলকে ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা করে তাদের কাজ ‘সর্বসাধারণের সেবা বা পণ্য’ (public good) এর উপর প্রভাব সম্পর্কে জানতে শিখতে হবে। (পৃ: ১৮৩-১৮৬) - সামাজিক পরিবর্তনের জন্য আইনপেশা সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখক বলেন, “একজন আইনজীবী কেমন হবেন, এটি একটি বৃহত্তর ধারণা- বৃহত্তর পরিসরের দক্ষতাসম্পন্ন পেশাদার কিন্তু একজন মানব যে তার সমগোত্রীয় মানবপ্রজাতি- মক্কেল ও বৃহত্তর সমাজের জন্য বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন ও যত্নশীলতা অনুশীলন করেন, যা মামলা পরিচালনার গণ্ডি অতিক্রম করতে পারে। সামাজিক পরিবর্তনের সহায়ক আইনজীবী তাদেরকে বলা যায়, যাদের কাজ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় স্থিতাবস্থার কিছু বিষয়কে পরিবর্তন করার জন্য পরিচালিত হয় এবং যারা বিশ্বাস করেন যে, বর্তমান সামাজিক অবস্থা সাধারণ জনগণের পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণে ও পর্যাপ্ত সুবিধাদি প্রাপ্তিতে বিপত্তি তৈরি করে” (পৃ: ১৭৯-১৮০)।
- নৈতিকতা সম্পর্কে লেখক শেষ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি লর্ড চেন্সেলর’স এডভাইজারি কমিটি অন লিগ্যাল এডুকেশন এন্ড কনডাক্ট (এসিএলইসি) অব ইউকে তার প্রথম প্রতিবেদনে বলেছে- “আইনশিক্ষার ও প্রশিক্ষণের সকলস্তরের লক্ষ্য হবে- বুদ্ধিবৃত্তিক ইন্টিগ্রিটি ও মনের স্বাধীনতা, সাধারণ নীতিমালার জ্ঞান, আইনের উন্নয়ন ও প্রকৃতি, আইনজীবীদের প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণাত্মক ও ধারণাগত দক্ষতা এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক, দার্শনিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতিতে আইনের প্রসংশা ও একই সাথে আইনী-মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার। এই প্রতিবেদনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল যে, আইনের শিক্ষার্থীদের বহুমুখী অবস্থায়আইনের সমস্যাসমূহকে পরীক্ষা করে উৎসাহিত করতে নিচের বিষয়সমূহ অন্তর্ভূক্ত করতে-
(১) সংসদ কর্তৃক আইন ও নজিরের(statutes and precedents) মাধ্যমে অবরোহন পদ্ধতি অবলম্বন করে প্রথাগত আইনী-যুক্তি;
(২) নীতিগত ইস্যু অনুধাবন করতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক পদ্ধতি ব্যাবহার করা;
(৩) অন্যান্য ব্যবস্থাসমূহকে বিবেচনার জন্য একটি তুলনামূলক পন্থা;
(৪) আইনের দর্শন তথা জুরিপ্রুডেন্স; ও
(৫) নৈতিক মূল্যাবোধ। (পৃ: ১৭১) - পরিশেষে তিনি উল্লেখ করেন, “আইনজীবীদের অবশ্যই মক্কেল ও সামাজিক স্বার্থকে সমুন্নত করতে ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে উঠতে হবে; বিচারকদের অত্যন্ত সতর্কতা ও যতনের সাথে বিচারিককার্য সম্পন্ন করতে হবে; অন্য সকল আইনী এক্টিভিস্ট তাদের কাজকে উৎসর্গের ও দুর্ভোগের শিকার মানবতার স্পিরিটের সাথে নিয়োজিত করতে হবে, আর আইনী-মূল্যবোধ হল সকল উচ্চাকাঙ্খার ভিত্তি-প্রস্তর। তিনি মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে এই অধ্যায়টি শুরু করেছেন এক বিখ্যাত উক্তি দিয়ে,
“আমি এ বিষয়ে আইনজীবীদের বলছি- আপনাদের উদ্দীপনাকে আপনাদের হৃদয়ের-রক্তের-মত-উষ্ণ হতে দিন, কিন্তু ইহাকে সুবিচার ও আত্ম-মর্যাদার সাথে পরিবর্তন হতে দিন; আপনাদের স্বাধীনতাকে সুদৃঢ়, আপোষহীন হতে দিন, কিন্তু ব্যক্তিগত উদারতার মাধ্যমে অন্যকে তা অনুভব করতে দিন; আপনার মুক্তির ভালবাসাকে প্রবল অনুরাগে পরিণত হতে দিন, কিন্তু এটা যেন বিদ্বেষপূর্ণতার আবরণ হিসাবে আবির্ভূত না হয়… …’Mr Justice Crampton, in R v. O’Connel (1884) 7 ILR 261, 312′
উপসংহারে বলতে চাই, বইটি পড়ে আমি এতই আন্দোলিত হয়েছি, আইনের জগতে আমার এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণে বইটি বেশ বৈচিত্র্য এনেছে। বইটি পড়লে লেখকের আইন ও আইনপেশার প্রতি মমত্ব ও অঙ্গীকার উপলদ্ধি করা যায়। বইটি যেহেতু অনেকগুলো প্রবন্ধের সম্মিলন, তাই বেশকিছু ধারণার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে (যা লেখকও প্রাক-কথনে উল্লেখ করেছেন) কখনও অনুভব করলেও পাঠচ্যুতি ঘটায়নি। বইটির সবচেয়ে শক্তিশালী দিক হচ্ছে, পৃথিবীর আধুনিকতম তাত্ত্বিক পটভূমির উপর বাংলাদেশের আইনশিক্ষার দুর্বলতা ও আইনপেশার সীমাবদ্ধতা যেমন উল্লেখ আছে তেমনি অভিজ্ঞতা থেকে এর উন্নয়নের কিছু সুনির্দিষ্ট পরামর্শও আছে। বইটিতে আইনপেশাজীবীদের মামলা পরিচালনার বাইরেও অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকা আছে, তার অনুধাবন সুস্পষ্ট। বাংলাদেশের আইনপেশার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠার জন্য বইখানি হতে পারে একটি দিকনির্দেশিকা। যার মাধ্যমে ‘আইন-ব্যাবসা’ থেকে বিজ্ঞ ‘আইনপেশা’য় রূপান্তরিত হতে পারে। আর এর মাধ্যমে ‘অদম্য আইনপেশা’র অভিযাত্রা বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্খা- সাম্য, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা অর্জনে হতে পারে পাথেয়।
লেখক : অ্যাডভোকেট, ঢাকা জজ কোর্ট; ই-মেইল : ram.chandra.das@gmail.com