ভূমিসংক্রান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র, বিশেষ করে সিএস, আরএস, এসএ, বিএস খতিয়ান বা পর্চার বিষয়গুলো সম্পর্কে সাধারণের ধারণা কম। এ সুযোগে ভূমি ও সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলোয় অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে দালালচক্র গড়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে হয়রানির শিকার হন সাধারণ মানুষ। এ সংক্রান্ত নানা অনিয়ম ও জটিলতা বিবেচনায় এনে ভূমি ব্যবস্থাপনা সহজ করতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে আরএস খতিয়ান ও নামজারি অনলাইনে চালু করা হয়েছে। যে কোনো স্থান থেকে মাত্র ৫ মিনিটে অনলাইনে জমির খতিয়ানের কপি সংগ্রহ করা যাবে। ফলে ভূমি অফিসগুলোয় দালালদের দৌরাত্ম্য কিছুটা হলেও কমবে। জটিলতা কমাতে সর্বশেষ ভূমি জরিপে প্রকাশিত খতিয়ান পরীক্ষায় উঠে আসা ১ হাজার ১২৪টি শ্রেণির ভূমিকে মাত্র ১৬ শ্রেণিতে রূপান্তর করেছে মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দুর্নীতি কমানোর উদ্যোগ হিসেবে মন্ত্রণালয় ও এর অধীন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নেওয়া হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তাদের দাবি, সম্পদের হিসাব শুধু কর্মচারীদের নিলেই হবে না, কর্মকর্তাদেরও নিতে হবে। মন্ত্রণালয়ের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, ভূমি মন্ত্রণালয় ও এর আওতাধীন পাঁচটি দপ্তর এবং ৬৪টি জেলায় কর্মরত ১৭ হাজার ৫৭৬ কর্মচারীর মধ্যে ১৭ হাজার ২০৮ কর্মচারী তাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী গত ৯ মার্চ দাখিল করেন। অবশিষ্ট ৩৬৮ কর্মচারী বিভাগীয় মামলায় সাময়িক বরখাস্ত এবং দীর্ঘমেয়াদি ছুটিতে থাকায় সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে পারেননি।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভূমির ১৬টি শ্রেণি হলো বন, পাহাড়, নদী, জলাভূমি, রাস্তা, টার্মিনাল, বন্দর, আবাদি, আবাসিক, অফিস, বাণিজ্যিক, শিল্প, বিনোদনকেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্মৃতিস্তম্ভ ও ধর্মীয় স্থান। ভূমির শ্রেণিকে সহজবোধ্য ও বাস্তবোপযোগী করতেও মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাক্ছুদুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, গত বছর ১২ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সভায় বিদ্যমান ভূমি জরিপ কার্যক্রমে ১৫৩টি শ্রেণির ভূমিকে ১০-১২টি শ্রেণিতে রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে সব জোনাল সেটেলমেন্ট অফিস থেকে সদ্যপ্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৩৩৯টি (কমবেশি) শ্রেণির অস্তিত্ব রয়েছে। আর সর্বশেষ জরিপে প্রকাশিত খতিয়ান পরীক্ষা করে দেখা যায়, বর্তমানে প্রায় ১ হাজার ১১৪ শ্রেণির অস্তিত্ব রয়েছে। জমির এমন জটিল শ্রেণিবিভাগ কমিয়ে মাত্র ১৬ শ্রেণিতে রূপান্তর করা হয়। ফলে সাধারণ মানুষ সহজে শ্রেণিবিভাগ বুঝতে পারবে। সম্প্রতি ‘হাতের মুঠোয় খতিয়ান’ স্লোগানে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ আরএস খতিয়ান অনলাইনে অবমুক্তকরণ করেন। land.gov.bd বা rsk.land.gov ও www.minland.gov ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ঘরে বসে অথবা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে অনলাইনে খতিয়ানের কপি সংগ্রহ করা যাবে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের সহায়তায় নতুন এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জানান, দেশে প্রায় ৬১ হাজার ৫০০ (তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া) মৌজা রয়েছে। এর মধ্যে ৪১ হাজার মৌজার জরিপ সম্পন্ন হয়েছে, এর প্রায় ৩২ হাজার মৌজার জরিপে প্রকাশিত ১ কোটি ৪৬ লাখ আরএস (১৯৬৫ সাল থেকে চলমান জরিপে প্রস্তুত করা খতিয়ান) খতিয়ানের তথ্য অনলাইনে পাওয়ার সুযোগ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, জরিপ কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া এবং জরিপ শেষ হয়েছে এমন খতিয়ানগুলো পর্যায়ক্রমে আপলোড করা হবে। জরিপ কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পর চূড়ান্তভাবে গেজেট প্রকাশিত খতিয়ানও এসব লিংকে আপলোড করা হবে। ফলে খতিয়ান নিয়ে সাধারণ মানুষের হয়রানি দূর হবে। কর্মকর্তারা জানান, প্রচলিত পদ্ধতিতে খতিয়ানের কপি পেতে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। নতুন ব্যবস্থায় এটা থাকবে না। খতিয়াতের কপি পেতে ভূমি অফিসে বা ডিসি অফিসে দৌড়াতে হবে না জমির মালিককে।
আর ভূমি সচিব মো. মাক্ছুদুর রহমান পাটওয়ারী বলেন, প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের অফিসের রেকর্ডরুম থেকে খতিয়ান বা পর্চা দেওয়া হয়ে থাকে। খতিয়ানের কপি প্রাপ্তিতে জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা পরিহার, সময়, খরচ ও যাতায়াত ভোগান্তি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য হ্রাস এবং ভূমিসংক্রান্ত সেবা আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহি করার জন্য অনলাইনে আরএস খতিয়ান চালু করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, খতিয়ান পেতে জমির মালিককে সরাসরি আবেদন করা লাগে, টাকা খরচ হয়। কিন্তু অনলাইনের এসবের কিছুই লাগবে না। জমির মালিক পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে অনলাইনে তার জমির খতিয়ান দেখতে পাবে। এতে তাদের আর ভোগান্তি থাকবে না।
মাক্ছুদুর রহমান পাটওয়ারী আরও বলেন, জনগণকে দ্রুত সময়ে সেবা দিতে বর্তমানে ৩০২টি উপজেলায় ই-মিউটেশন কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। আরএসকে (রিভিশনাল সার্ভে খতিয়ান) সিস্টেম ও ডিডিআর বা ডিজিটাইজেশন অব রেকর্ড রুমের মাধ্যমে সিএস, এসএ ও আরএস খতিয়ান অনলাইনে সরবরাহের পরিপত্র জারি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, জমির মালিকানা পরিবর্তনের মাধ্যম হচ্ছে নামজারি। এ নামজারি নিয়ে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বহু পুরনো। আমরা নামজারিও অনলাইনে চালু করেছি। আগে নামজারি করতে দুই মাস লাগত। বর্তমােেন মাত্র ২৮ দিনেই নামজারি শেষ হবে। আগামী জুনের মধ্যে দেশের শতভাগ উপজেলায় অনলাইনে নামজারি চালু করা সম্ভব হবে। ভূমি সচিব আরও জানান, যারা বিদেশে কাজ করেন তাদের জমির নামজারি করতে মহানগরীর মধ্যে সময় লাগবে ১২ দিন আর মহানগরীর বাইরে অন্যান্য স্থানে মাত্র ৯ দিনেই হবে নামজারি।