আবদুল্লাহ আল মামুন :
প্রথমে একটা ছোট্ট তথ্য দেই- বাংলাদেশের আদালতে ৩৭৭ ধারায় (অস্বাভাবিক যৌন কামনা চরিতার্থ করার অপরাধ) চলমান প্রায় সব মামলার অভিযুক্ত মাদ্রাসার হুজুর/হাফেজ। অনেকগুলো মামলায় আবার ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আছে। আপনার যদি বিশ্বাস না হয় তবে থানায় বা আদালতে খবর নিতে পারেন। আমার প্রশ্ন- কেন? মাদ্রাসায় যারা পড়ে তারা শিশু, কিশোর এবং তারা ধর্মীয় শিক্ষার জন্য সেখানে যায়। তাদের যারা পড়ান তারা অত্যন্ত জ্ঞানী লোক। এই শিশু, কিশোরদের কাপড় চোপড়ে কি সমস্যা থাকে? তারা কি উগ্র কাপড় পরে??
বেশ কিছু আগ্রহউদ্দীপক পোস্ট দেখতে পাচ্ছিলাম “গা ঘেঁষে দাঁড়াবেন না” টি শার্টে এই লেখা দেখে। মেয়েগুলো জিন্স পরিহিত। ফেসবুকের প্রথম বিদ্রোহীরা বলছেন- বোরকা পরলে কি এমন হতো? দ্বিতীয় গ্রুপের প্রতিক্রিয়া হলো- বাসে চড়তে গেলে গা লাগতেই পারে। এ আর এমন কি? তৃতীয় গ্রুপের প্রতিক্রিয়া হলো- লিখেছেই যখন দাঁড়ানো তখন যথার্থ! চতুর্থ গ্রুপের বক্তব্য- আরো কুরুচিপূর্ন কিছু ট্রল দিয়ে ছেড়েছে।
সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে ধর্ম, সমাজ, চলাফেরা সব একাকার হয়ে গিয়েছে। আমি নিশ্চিত এদের মধ্যে সম্ভাব্য গা ঘেঁষে দাড়ানোরা আছেন। ছিলেন। থাকবেন। এখন একটা প্রশ্ন হচ্ছে – নারীর চলাচল কি নিরাপদ? উত্তরটা হচ্ছে- বাবার বা স্বামীর বা নিজের টাকায় একটা গাড়ি থাকলে বা উবার, পাঠাও, ট্যাক্সিতে চড়ার সামর্থ্য থাকলে আপনি গা ঘেঁষাদের হাত থেকে নিরাপদ। নয়তো নয়। তবুও তো গাড়ি থেকে আপনাকে বের হতে হবে। আপনাকে লিফটে উঠতে হবে। কাজ করতে হবে।
চট্টগ্রাম আদালতে একজন বিজ্ঞ পুরুষ আইনজীবী আছেন যিনি ” গুতা….” নামে পরিচিত। তিনি মহিলা আইনজীবী পেলেই গুতা মারেন। প্রবীণরা নবীনদের সাবধান করেন। কেউ কেউ হাত ভেঙ্গে দেবেন বলেন। কিন্তু এই গুতানোর অভ্যাস তিনি বয়েই চলেছেন। নারী আইনজীবীরা আদালতে কোর্ট, গাউন পরে থাকেন। ড্রেস সংক্রান্ত সমস্যা তাদের নেই। তাহলে এই গুতা…..থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কি? আদালতের ভীড়ে তিনি তার কাজ নিরলস ভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন। তার মা, বোন, মেয়ে আছে কিনা এটা অবান্তর। সুতরাং, জিন্স না পরে যদি বোরকা পরতেন তবে সম্মানিত বিদ্রোহীদের কেউ নিশ্চয় গা ঘেঁষে দাড়াতেন না!! এই অবস্থা দেশের অন্য আদালতে, কর্মক্ষেত্রে নেই সেটা ভাবার কি অবকাশ আছে? মেয়েরা সব ক্ষেত্রেই অনিরাপদ। নিরাপদ নয় আপনার পুরুষ শিশুটিও। কিংবা বাচ্চার কেয়ারটেকার। কাকে বিশ্বাস করবেন আপনি??
ওরা ভুলে যাচ্ছে এই দেশে ২/৩ বছরের বাচ্চাকে ব্লেড দিয়ে কেটে ধর্ষণ করা হয়েছে। ফেনীর মেয়েটা এখনো ৮০ শতাংশ পোড়া নিয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। আর ওর করা মামলায় মাদ্রাসা অধ্যক্ষ এখনো জেলে। কারা ওর গায়ে আগুন লাগিয়েছে? বোরকা পরা মাদ্রাসার ৪ জন ছাত্রী যাদের আটক করতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং, বোরকা পরলেই কেউ গা ঘেঁষে দাঁড়াবে না এই ধারণা ভুল। বিশ্বাস না হয় বোরকা পরে বাসে দাঁড়িয়ে দেখুন। অথবা কাউকে জিজ্ঞাসা করুন। ওদের কাছে নারীর কোন কাপড় নেই, বয়স নেই, জাত নেই, শ্রেণী নেই। স্রেফ নারী হলেই হলো।
গণপরিবহন বলে কিছু বাংলাদেশে নেই। থাকলেও তা মেয়েদের জন্য কতটা নিরাপদ তা আপনার মা, বোন, মেয়েকে জিজ্ঞাসা করুন। গণপরিবহন ব্যবহার করে আপনি যদি বাংলাদেশের ১০০ টা মেয়েকে জিজ্ঞাসা করেন তবে ৯৯ জনই হয়তো উত্তর দেবে গণপরিবহনে চলার সময় তারা কি অভিজ্ঞতা পেয়েছেন। সেটা বাসের হেল্পার থেকে শুরু করে ড্রাইভার পর্যন্ত বিস্তৃত। ড্রাইভার কি ভাবে আসলো? ড্রাইভারের পাশে বসার সীট থাকে দেখেননি?!! আপনি যদি কাক হন তবে ভুলে যাবেন ভারতে নির্ভয়া বা বাংলাদেশে একাধিক মেয়ের বাসেই গণধর্ষণ, এরপর মেরে ফেলে বা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে মৃত্যুর ঘটনা যা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছিলো। আপনার মা, বোন, বউ এখনো পর্যন্ত এর শিকার হননি বলে নফল নামাজ পড়ুন।
বাসে যৌন নির্যাতন বা হয়রানির ঘটনায় আপনি কখনো প্রতিবাদ করেছেন? দর্শক হয়েছেন? ধরে পুলিশে দিয়েছেন? নিজের বোনকে নিরাপদ রেখে বুঝি আরেকজনের গা ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছেন?? গা ঘেষে দাঁড়াবেন না- এটাতে পুরুষ বিদ্বেষ পাচ্ছেন?? থানায় বা আদালতে এর একটাও কি আসে?
একটা গল্প শুনুন- অনেক দূর থেকে একটা মেয়ে আসছে। একজন বন্ধু খুব রসালো বর্ননা দিচ্ছে। কাছে আসতেই দেখা গেলো মেয়েটা ঐ বন্ধুরই ছোট বোন।
নারীর নিরাপত্তা তখনই নিশ্চিত হবে যখন ঘরের পুরুষটি নিরাপদ হবে। গা ঘেঁষার বদলে আপনি প্রতিবাদী হবেন। আপনি চলার পথে আপনার নারী সহযাত্রীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। তিনি মানুষ। কোন পণ্য সামগ্রী বা খাবারের বস্তু নন যে আপনার জিভে জল আসবে। পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে আপনি নিজে অন্যের জন্য নিরাপদ হোন। সেটা সব জায়গায়। শুধু বাহনে নয়। পরিবারে, কাজের ক্ষেত্রে সব জায়গায়। আপনার কাছে নিজের সন্তান, অন্যের কন্যা/পুরুষ শিশু নিরাপদ থাকুক। আপনার শিশু, বোন, আশপাশের শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তাদেরকে ভালো আদর, খারাপ আদর শেখান। মুখ খুলতে বলুন। অধিকাংশ মানুষ কম বয়সে খুব কাছের আত্মীয়ের “গা ঘেঁষার শিকার হয়। আপনি সেটা প্রতিহত করুন। চেষ্টা করুন। যে শৈশব, কৈশোর আপনি পেয়েছেন তা আপনার উত্তরসূরী যেন না পায়।
গা ঘেঁষাদের প্রতিহত করুন। এরা আর কেউই নয়। সম্ভাব্য ধর্ষণকারী, শিশু/কিশোর নির্যাতনকারী।
হলের সামনে বিকৃত রুচির রিক্সাচালক, পেছনে নারী যাত্রী নিয়ে ট্যাক্সিচালকের কীর্তি, বাসের যাত্রীর পাশের সিটের মহিলা দেখেই কীর্তি -এগুলো কোনক্রমেই পুরুষ বা মানুষের নয়। কুকুরেরও নয়। সুতরাং গা ঘেঁষারও প্রয়োজন পড়ছে কি? এগুলো অমানুষ, বিকৃত রুচির লোক।
সমস্যাটা কাপড়ে নয়। মাথার যে জায়গায় ব্রেন থাকে সেখানে। সমস্যাটা ধর্মে নয়। নিউরনের অনুরননে যে বিকৃত চিন্তার সৃষ্টি হয় সেখানে। সমস্যাটা মা, বোনে, স্ত্রীতে নয়। অন্য মানুষকে সম্মান দিতে না জানার শিক্ষায়, চেতনায়। ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহার করার তাড়নায়।
আপনি যদি উপরের কোন ক্যাটাগরিতেই না পড়েন তবে আপনি পুরুষ, নারী, শিশু, কিশোর, কিশোরী, বৃদ্ধের জন্য নিরাপদ একজন মানুষ। আপনাকে অভিবাদন। আপনি গা ঘেঁষাদের দলে পড়েন না। এটা ফৌজদারী অপরাধ। অযথা গা ঘেঁষে ধরা পড়লে উপযুক্ত আদালতের বিচারে জেল-জরিমানা হয়ে যেতে পারে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ এর ১০ ধারা অনুযায়ী অন্যূন ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে। সাথে যুক্ত হতে পারে অতিরিক্ত অর্থদণ্ডও। সুতরাং, সাধু সাবধান। গা ঘেঁষাদের সাবধান করুন/বলুন।
লেখক : অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বান্দরবান পার্বত্য জেলা।